একটা মেয়ে ভীষণ অভিমানী
কাঞ্চনজঙ্ঘার মনের চূড়ায় এক দেশ
সেই সাদা দেশে সে জমিয়ে রাখে অভিমান
বরফের মত
পরতে পরতে।
প্রত্যেক সন্ধ্যাবেলা-
আমি ঘরে ঢুকে সেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখি।
যেন চূড়ায় শেষ বিকেলের আলোর প্রতিফলন
শান্ত, সৌম্য, স্থির
একটা মিস্টি গন্ধ
সম্পূর্ণতায় ভরে থাকা ঘর
একটি লক্ষী ঘর-
সেই ঘরে একটা জীবন কাটানো যায়।
কোনদিন সেই ঘরে সব বরফ ভেঙে পড়ে
হিমবাহ হয়ে।
আমি আবার মন খারাপ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখি,
ভাবি,
এই যে অভিমান
মানুষ তো জমিয়েই রাখে একদিন হিমবাহ হবে বলে।
উত্তর বাংলার আহত যুবক
যন্ত্র হতে মানুষ হওয়ার পথ খুঁজছি
সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
কাঞ্চনজঙ্ঘার অভিমান
শনিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
বড়বেলায়, বিকেলবেলায়
ছোটবেলার বিকেলে মানুষ খুশি হয়, আর যেদিন বিকেলে মানুষ প্রথম কষ্ট পায়- সেই দিন থেকে তারা বড় হয়ে যায়। এরপর পৃথিবীর যাবতীয় রীতি-নীতির মতো মিষ্টি বিকেলগুলো আর কোনদিন ফিরে আসে না। বড়বেলা এমনই!
বড়বেলার বিকেলে নিজেকে ঐ হাতিটা মনে হতে থাকে, পৃথিবীকে কাঁধে নিয়ে দাড়িয়ে থাকা হাতি। ভারবাহী, বোকা, স্থবির ঐ হাতি- কোথাও যাবার জায়গা নেই মহাকাশে শুধু শুধু একা একা এত কাজ ছিল জমে- কোন দিন করা হবে না। কোথাও ভালবাসা না পেয়ে হাতিটা আস্তে আস্তে মারা যাবে। বড়বেলা এমনই! [টাম্পা, ফ্লোরিডায়, এক পড়ন্ত বিকেলে]
বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৪
একটি উত্তরাধুনিক রোমান্টিক (প্রায়) কবিতা
এরিক ক্ল্যাপটনের গানগুলো ফুরিয়ে যাবে
স্পটিফাই বলবে সরি, নো ইন্টারনেট কানেকশন অ্যাভেইলএবল
খুঁজে পাওয়া যাবে না দে বেষ্ট অফ এলটন জন।
দু'য়েকটা লো ফ্যাট গ্রীক ইয়োগার্ট ছড়িয়ে থাকবে এদিক ওদিক
আধখাওয়া ক্যান্টালোপ আর স্কিমড মিল্ক বিদ্রুপ করবে
চ্যাড়ামো হচ্ছে?
মাথার কাছে ইতিউতি হাতড়াব
খুঁজে পাব না আবুল হাসান আর জয় গোস্বামী
দি গডস ডিলিউশন বইটা! কিনেছিলাম কি?
সেদিন বিকেলে আবার বসার ঘরে যাব
রাইজিং অ্যারিজোনার নিকোলাস কেজের মত বসে থাকব
তোমার অসংখ্য চুমুর জন্য বসে থাকব।
রবিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৪
হ্যাংওভার ০০১
এখনও, ওক্লাহোমা কিংবা ফ্লোরিডার বাতাসে।
ঝুলে পড়ে, হ্যাংওভার হয়ে।
শুক্রবার রাতে তাই-
আধুনিক যুবকরা বাকারডি কোলা খায় লং আইল্যান্ডে-
রাশান ওয়াল্টজ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় মোহাবি ডেজার্ট-
আর শনিবার বিকেলে
ধূলা ঝাড়তে থাকে শক্তি চট্রোপাধ্যায়ের!
সোমবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
সন্ধ্যেবেলা
যে পৃথিবী না-মানুষের
সেই পৃথিবীতে বাঁচি দিন শেষে।
প্রতি সন্ধ্যেবেলা শকুন ঘোরে হওয়ায়
আধুনিক গেরস্তের ঘরে ঢুকে খেয়ে যায় হৃদয়-
কিছুই হয়নি ভেবে নির্লিপ্ততা গ্রাস করে
ধারহীন নেইলকাটারে নখ কাটি-
ইউটিউব খেতে থাকি চা-সিগ্রেটের সাথে।
প্রতি সন্ধ্যেবেলা-
একটা মানুষ একটু একটু করে মরে যায়।
সোমবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১২
প্রিয় ইসরায়েলের জন্য কয়েকটা লাইন
হে ইসরায়েল,
হে পৃথিবীর জারজ সন্তান
তোমায় বলছি শোন-
বুঝেছ কিসের ব্যথা দিয়ে গেলে পিতাকে
শিশুর রক্তে ভিজে যায় হাত
শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে হৃপিণ্ড।
তোমার একেকটা বুলেট
একেকটা মর্টার
একেটা ক্ষেপণাস্ত্র
একেকটা মৃত্যুর গান হয়ে ঝড়ে পড়ে প্যালেষ্টাইনের বাতাসে।
হে ইসরায়েল,
তোমার জন্মান্ধ চোখ জুড়ে রক্ত
শিশু, কিশোর আর যুবকের রক্ত
মুখ-নখ-ঠোঁট আর কন্ঠনালী কি একবার দেখেছ আয়নায়?
এখনো কি গড়িয়ে পড়ছে না মা আর ভগ্নির রক্ত?
এত মৃত্যু আর রক্তের বিছানায়
কি করে ঘুমাও তুমি, হে ইসরায়েল?
আমি তো জেনেছিই এতদিনে
জেনেছ তুমি
মেশিনগানের বাঁধানো বুলেটে জড়িয়ে থাকে ভালবাসা
বন্দুকের নলের ভিতর ঘুরে ফেরে শুভদৃষ্টি
শুধুমাত্র লাল রংই হতে পারে এই পৃথিবীর
বুলেট আর কান্নার শব্দে
কি বা এমন পাথর্ক্য?
তবুও তুমি কি জান
শিশুর নিথর দেহ তুলে ধরতে কতটুকু শক্তি প্রয়োজন পিতার
মায়ের বুকের কোন অংশে থাকে মৃত শিশু
অথবা যে শিশু হামাগুড়ি দেয় রক্ত-মাটি আর পিতামাতার শরীরে
আর কতটুকু করলে মুছে যাবে মর্ত্যে আগমনজনিত অপরাধ?
জান কি? না। এতদিনে জেনেছি আমি। জান না।
কেননা তোমার কোন মা নেই
কেননা তোমার কোন বাবা নেই
কেননা তুমি, তোমার মাতাপিতাহীন এক পৃথিবীর
শুধুই একমাত্র জারজ সন্তান।
রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৯
অথচ সুনির্দিষ্ট কোন নারী নেই
অথচ সুনির্দিষ্ট কোন নারী নেই
অথবা মাউন্ট কেনিয়ার চূড়ায় জমে থাকা শুভ্র বরফ-
নেই তার মত কোন শীতল পরশ।
কিংবা বসরার গোলাপের মত চিবুক
একবার ছুঁয়ে দেখলে বহুবার মানুষ হয়ে জন্মাতে ইচ্ছা করে।
অথচ সুনির্দিষ্ট কোন নারী নেই-
হরহামেশাই শরীরের টানে
ফারেনহাইটের পারদ উপরে উঠে গেলে
আঁতকে ওঠা নারী নেই-
'জ্বরে যে শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে'
এমনটা কারও বলা নেই, তাই বলে
শুধুই শুয়ে থাকা
একা একা বৃষ্টি দে...অথচ সুনির্দিষ্ট কোন নারী নেই
অথবা মাউন্ট কেনিয়ার চূড়ায় জমে থাকা শুভ্র বরফ-
নেই তার মত কোন শীতল পরশ।
কিংবা বসরার গোলাপের মত চিবুক
একবার ছুঁয়ে দেখলে বহুবার মানুষ হয়ে জন্মাতে ইচ্ছা করে।
অথচ সুনির্দিষ্ট কোন নারী নেই-
হরহামেশাই শরীরের টানে
ফারেনহাইটের পারদ উপরে উঠে গেলে
আঁতকে ওঠা নারী নেই-
'জ্বরে যে শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে'
এমনটা কারও বলা নেই, তাই বলে
শুধুই শুয়ে থাকা
একা একা বৃষ্টি দেখা।
অথচ এমন কোন সুনির্দিষ্ট নারী নেই
সুনির্দিষ্ট দৃষ্টির ভিতরে গিয়ে আটকে থাকা নেই
সকালে বিকেলে সিগারেটের ধোঁয়ায় দমবন্ধ হবার কেউ নেই
একদম কেউ নেই।
তবুও কোন এক বিকেলে-
সূর্যের আলো কমে গেলে
লেবুপাতার গন্ধ পাওয়া যায়
শিরীষের ডালে হঠাৎ হঠাৎ আটকে যায় মন।
ঐ সুনির্দিষ্ট বিকেলেই
অনির্দিষ্ট নারীদের বড্ড ভালবাসতে ইচ্ছা করে,
ভালবাসতে ইচ্ছে করে।
রবিবার, ২৪ মে, ২০০৯
গল্প > মাজিদ মুনওয়ারের এক সকাল<
মাজিদ মুনওয়ার ঘুম থেকে উঠলেন সকাল সাড়ে ছয়টায়। গরমের দিন । বেশ সকালই হয়েছে। তার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। ফজরের নামাজটা কাজা হয়ে গেছে এটা না যত বড় কারন তার চেয়ে বড় হল কারন আজকের বয়ানের পয়েন্টগুলো ভোরে লেখা হল না এটা। মফস্বল শহরে একটা মাহফিলে সন্ধ্যার পর বয়ান দেওয়ার কথা তার। মফস্বলের মাহফিল। স্বাভাবিকভাবে অনেক লোকজনই হবে। তার বয়ানটাও তাই ভাল হওয়া দরকার। এই বয়ানে কি কি বিষয় নিয়ে বলবেন সেগুলোই পয়েন্ট আকারে লেখার কথা ফজরের নামাজের পর, এ সময় তার মাথা ভাল খোলে। অথচ তিনি উঠলেনই ভোর হওয়ার অনেক পরে, অসময়ে এখন আবার কাগজ কলম নিয়ে বসতে হবে। মাজিদ মুনওয়ার বামপার্শ্বে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। ময়না এখনও ঘুমিয়ে আছে। বিয়ের এতদিন পরেও ভোরে না ডেকে দিলে সে ফজরের নামাজ ধরতে পারে না। এত ঘুম ময়নার! ঘুমায়ও তো ঠিক দশটায়। সারাদিন কি এমন কাজটাই করে সে? কাজ বলতে তো সেই সকাল আটটা থেকে বারোটা পর্যন্ত মহিলা মাদ্রাসার মাষ্টারি। বাসায় কাজ করার জন্য দুটো চাকর। বাসার কোন কাজও তাকে করতে হয় না। অথচ তার ঘুম দেখলে মনে হয় দুনিয়ার সব কাজ একা করে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। মাজিদ মুনওয়ার ময়নাকে ধাক্কা দেন। ' এই ওঠ ' । ময়না চোখ ঘষতে ঘষতে উঠে বসে। মাজিদ মুনওয়ার ধমকের সূরে বলেন,' একদিনও তো আমারে জাগায়ে দিতে পারলা না, ফজরটা কাজা হয়ে গেল'।ময়নাও পাল্টা ধমকের সূরে বলে ,' ভোরে উঠবেন কেমনে । সারারাত তো পার্টির কাজ করে আসেন '। ময়নার কথা অবশ্য মিথ্যা না। কয়েকদিন হল পার্টি অফিসে গভীর রাত অবধি কাজ করতে হচ্ছে মাজিদ মুনওয়ারকে, কালকেই অফিস থেকে বেড়িয়েছেন প্রায় সোয়া বারোটায়। দেশে যুদ্ধপরাধী নিয়ে ডামাডোল শুরু হয়েছে। বিষয়টা নিয়ে পার্টির নেতৃস্থানীয় লোকজন খুব চিন্তিত। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ক্ষমতায়, যে কোন কিছুই হওয়া সম্ভব। সামনে দিনে এই বিষয়টা আরো জট পাকিয়ে গেলে পার্টির কৌশলগত দিকগুলো কি কি হবে এগুলো নিয়েই আলোচনা চলছে তিন দিন ধরে। পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতারা থাকছেন, আলোচনা হচ্ছে, মাজিদ মুনওয়ারও সেখানে থাকছেন। মিটিং শেষ করে বেড়িয়ে পড়তে পড়তেই রাত বারোটা পেরিয়ে যাচ্ছে। সকাল আটটায় ময়না মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যাওয়ার পর মাজিদ মুনওয়ার যখন তার লাল কভারের বয়ানের খাতাটায় লেখা শুরু করবেন বলে ভাবছেন তখন তার মোবাইল ফোনে একটা কল আসে। মাজিদ মুনওয়ারে ভ্রু কুঁচকে যায়। তিনি শান্ত গলায় ' রং নাম্বার ' কথাটা বলে কলটা কেটে দেন। মোবাইল ফোনের অচেনা নাম্বারটির দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পারেন কলটা তার কোন আত্নীয়ের কাছ থেকেই সম্ভবত হবে। মাজেদ মনোয়ার থেকে মাজিদ মুনওয়ার হয়েছেন তিনি বেশ আগেই। একজন ইসলামিক স্কলারের নাম মাজেদ, মনোয়ার এইসব হবে এটা কেমন কথা? পিতৃপ্রদত্ত নামটা তিনি তাই পাল্টে দিয়েছিলেন অনেক আগে, তফসীরে কোরআন হওয়ার পরপরই। এলাকার অল্প কিছু লোকজন আর নিকট আত্নীয়রা ছাড়া দেশের সব লোক আজ তাকে মাজিদ মুনওয়ার নামেই জানে। তাই, তাকে মাজেদ বলে সম্বোধন করা মোবাইল ফোনের এ নাম্বারটা যে তার গ্রামের কোন আত্নীয়ের এ বিষয়ে তার কোন সন্দেহ থাকে না। আত্নীয়-স্বজনদের মধ্যে অধিকাংশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। এরা নানান সময়ে মাজিদ মুনওয়ারকে ফোন করে যন্ত্রনা করে, টাকা পয়সা সাহায্য চায়। যেন তিনি দুনিয়ার সব টাকা-পয়সা হাতে নিয়ে সাহায্য করার জন্য বসে আছেন। মেজাজাটাই খারাপ হয়ে যায়। মাজেদ সম্বোধন করে আসা ফোন ইদানিং তাই তিনি আর সেরকম ধরছেন না। মাজিদ মুনওয়ার আবার লিখতে বসেন। বয়ানের পয়েন্টগুলোতে যাওয়ার আগে তিনি খাতায় দুটি তারকা চিহৃ দেন। ইদানিং ছোটখাট বিষয়গুলো তার মনে থাকছে না, সবই তাই নোট হিসেবে লিখে রাখতে হচ্ছে। প্রথম তারকার পাশে তিনি লেখেন " দলকে বেশি করে প্রমোট করতে হবে "। গত কয়েকদিনের পার্টির সভাতে এই কথাটা বার বার করে এসেছে। যুদ্ধপরাধী বিষয়ক ডামাডোলের মধ্যে দলের পজেটিভ প্রচারটা ফলাও করে করতে হবে। তারা যে আল্লাহর দল করছেন, তাঁর পন্থা বাস্তবায়নের জন্য জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, এটা সর্বসাধারণের মধ্যে আরো বেশি করে ছড়িয়ে দিতে হবে। এজন্য পার্টির যে সমস্থ ইসলামিক স্কলাররা বিভিন্ন মাহফিলে বয়ান করেন তারা যেন বেশি করে ঐ সব বয়ানে পার্টিকে প্রমোট করেন, এটাই পার্টি থেকে তাদের উপর নির্দেশ। মাজিদ মুনওয়ার "দলকে বেশি করে প্রমোট করতে হবে " কথাটার উপর আরেকবার কলম ঘোরান, বোল্ড করা বাক্য তাড়াতাটাড়ি চোখে পড়বে হয়ত এ ভেবেই। এরপর দুই নম্বর তারকার পাশে দ্বিতীয় পয়েন্টটা লেখেন। তিনি লেখেন ," আঞ্চলিকতার টান পরিহার করতে হবে "। আঞ্চলিকতার সমস্যাটা তার যাচ্ছেই না, বয়ানের সময় আঞ্চলিক শব্দ বা টান কথার মধ্যে এসে যাচ্ছে। এই যেমন গত সপ্তাহেই একটা বয়ানে দেশের দুই নেত্রীর কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন "আল্লাহ এই দুই বেডীরে হেদায়েত করুন"। মাহফিলে অনেক আধা নাস্তিক শিক্ষিত লোকও আসে। বয়ানের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললে, কথার মধ্যে আঞ্চলিকতার টান থাকলে তারা ভাববেটা কি? তাদের কাছে তিনি তাহলে পৌছাবেনই বা কিভাবে? তাকে তাই এই বিষয়টাও বেশ ভাল করে খেয়াল করতে হচ্ছে। পয়েন্ট দুটো লেখার পর মাজিদ মুনওয়ার হাজেরাকে চা দিতে বলেন। হাজেরা এ বাসায় কাজ করে। হাজেরাটা বড় হচ্ছে। ফ্রকের মধ্য দিয়ে শরীরটা প্রায় ফুঁড়ে বের হয়ে আসে । ওদিকে তাকালেই সে ফ্রকটা ঠিকঠাক করে নেয়। মাজিদ মুনওয়ার বুঝতে পারেন বয়স কম হলে কি হবে তার এ দৃষ্টি ঠিকই সে ধরতে পারে। তিনি এও বুঝতে পারেন এই মেয়ে আর বেশিদিন এ বাসায় থাকতে পারবে না। এই মেয়েগুলোর এই এক সমস্যা। ইসলামে দাস-দাঁসির উপর মালিকের যে একটা বৈধ হক আছে হাজারবার নসীহত করার পরও এরা সেটা বুঝতে পারে না। শরীরে দু-একবার হাত দিলেই কেটে পড়ে। সিদ্দিকটা ছিল বলে রক্ষা। একটা চলে গেলে কোত্থেকে কোত্থেকে জানি সে আরেকটা কম বয়স্ক মেয়ে ধরে আনে। অবশ্য করবেনা কেন? তিনি তো তার জন্য কম করেন নি? হাজেরা চা দিয়ে গেলে মাজিদ মুনওয়ার দারুচিনি আর আদা দেয়া চা টায় চুমুক দিতে দিতে লিখতে থাকেন। গত কয়েকটা মাহফিলে কয়েকটা বড় সূরা তেলাওয়াতের পর তিনি' মুসলমানদের জমিন ' কথাটার প্রচার দিয়ে বয়ান শুরু করছেন। এবারও তিনি এটা করবেন। তবে এবার শ্রোতাদের সাথে ইন্টারাকশানটা আরো বাড়াতে হবে। এবার শুরুই করতে হবে একটা প্রশ্ন দিয়ে। শ্রোতাদের কাছে প্রশ্ন করবেন ' বাংলার এ জমিন কার, খ্রিষ্টানদের? '। গুটিকয় লোক ছাড়া প্রায় সবাই নিরুত্তর থাকবে। সব মাহফিলেই এরকমটা হয়, শ্রোতারা প্রথমে নিরুত্তর থাকে, এদের জাগিয়ে তুলতে হয়। তিনি বলবেন, ' কি? কথা বলেন না কেন? বলেন এ জমিন কি খ্রিষ্টানদের?'। শ্রোতারা তখন সমস্বরে বলবে ' না '। এরপর তিনি পরপর আরো এরকম কয়েকটা প্রশ্ন করবেন। ' বাংলার এ জমিন কি ইহুদিদের? নাসারাদের? বিধর্মী- নাস্তিকদের? '। সবাই প্রতিবার সমস্বরে ' না ' বলার পর তিনি বলবেন , ' তাহলে এবার বলেন এ জমি আসলে কাদের? বলেন কাদের ? মুসলমানদের, জোরে বলেন মুসলমানদের'। শ্রোতাদের কাছ থেকে মুসলমানদের নামটা তিনি আরো কয়েকবার শুনবেন যতক্ষণ পর্যন্ত না চারদিকে ' মুসলমান ' শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এরপর তিনি গলার স্বর দ্বিগুন বাড়িয়ে বলবেন, ' হ্যাঁ, এ জমিন মুসলমানের, বাংলার এ জমিন হাজী শরীয়তউল্লাহ, শাহজালাল, শাহ মখদুম, ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খিলজী আর নজরুলদের- রবীন্দ্রনাথদের নয় '। এরপর রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলকে নিয়ে তিনি কয়েকটা তুলনামূলক কথা বলবেন। প্রতিটি মাহফিলেই তিনি এগুলো বলেন, মুখস্ত আছে। এটা অনেকটা এরকম , ' হ্যাঁ , নজরুলের জমিন রবীন্দ্রনাথের নয়। কাজী নজরুল ইসলাম যখন বাংলা থেকে ব্রিটিশদের তাড়াতে কবিতা লিখছিলেন আর সেজন্য জেল খাটছিলেন , তখন রবীন্দ্রনাথ কি লিখছিলেন জানেন ? জানেন তিনি কি লিখছিলেন? '। শ্রোতারা নিরুত্তর থাকবে। তখন তিনি ব্যঙ্গোক্তির সূরে গাইবেন ,' ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা '। গানের ব্যঙ্গাত্মকতার খাতিরেই হোক অথবা বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বুঝেই হোক লোকজন হেসে ফেলবে। এটারও দরকার আছে। রসকষহীন বয়ান মাজিদ মুনওয়ার পছন্দ করেন না। কিন্তু লোকজনের এই হাসি মাটিতে ফেলতে দেয়া যাবে না। হাসির শব্দ মিলিয়ে যাবার আগে গলায় একটা প্রকট গর্জন তুলে বলতে হবে,' কি বেয়াদাতি, নাফরমানি কাজকারবার, একমাত্র আল্লাহতায়ালা ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নত করা শিরক '। মাজিদ মুনওয়ারের এই গর্জন শুনে শ্রোতাদের হাসিমুখ শক্ত হয়ে যাবে। তাদের এই শক্ত মুখের উপরেই ইসলাম শিক্ষার ব্যাপারটা আটকিয়ে দিতে হবে। মুসলমানের জমিন যে ইসলামের শিক্ষা ছাড়া চলতে পারে না , চলা উচিতও নয় , এ বিষয়টা তাদের ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার যে কি বেহাল অবস্থা চলছে এটা বুঝানোর জন্য মাজিদ মুনওয়ার কয়েকটা ছড়ার আশ্রয় নেন। গত সপ্তাহের মাহফিলে তিনি বলেছেন ' হট্টিমাটিমটিম, তারা মাঠে পাড়ে ডিম, তাদের খাঁড়া দুটি শিং' ছড়াটার কথা, আজকের মাহফিলটায় বলবেন ' আগডুম বাগডুম ' ছড়াটার কথা। মাজিদ মুনওয়ার এই ছড়াগুলো মাহফিলে আবৃতির ঢংয়ে পড়ার সময় কিছুটা বিব্রত বোধ করেন কারন এজন্য তাকে কিছু নির্জলা মিথ্যা বলতে হয়, গল্প বানাতে হয় ছোট মেয়েটাকে নিয়ে। তিনি ঠিক করেন এবার বলবেন এরকম করে,' এই দেশে ইসলামের শিক্ষাকে পাঠ্য করা হয় নি, যা পাঠ্য করা হয়েছে তার থেকে আমরা শিখেছি? কি শিখেছি আপনারা শুনবেন?'। তিনি মুখটা কৌতুকময় করে শ্রোতাদের দিকে এমনভাবে তাকাবেন যে , তারা আসন্ন কৌতুকের সম্ভাবনায় আহলাদিত হয়ে মুখ গোল করে বলবে ' শুনব '। তখন তিনি বলবেন,' আমার ছোট মেয়েটা কয়েকদিন আগে গেছে স্কুলে। সেখানে মাষ্টার কি শেখায় জানেন? শেখায় ' আগডুম '। মেয়ে আমার আগডুম বোঝে না । সে স্যারের কাছে জানতে চায় স্যার আগডুম কি? স্যার তখন বলেন ' বাগডুম ' । মেয়ে বাগডুমও বোঝে না। সে স্যারের কাছে আবার বাগডুম কি জানতে চায়। স্যার তখন বলেন ,' ঘোড়াডুম সাজে' । মেয়ে আগডুম-বাগডুম-ঘোড়াডুমের কিছুই না বুঝে বাসায় এসে আমাকে বলে ,' আব্বা স্কুলে স্যার কি শেখায় কিছুই বুঝতে পারি না '। এখন ভাইয়েরা আপনারাই বলেন আগডুম, বাগডুম, ঘোড়াডুম এইসব কি? এইসবের কি বাস্তবে কোন অর্থ আছে। মানে একেবারে ছোট থেকেই আমরা মিথ্যা শিখে আসছি। এই হল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। অথচ কুরআন-হাদীসে বারবার এসেছে কৌতুক করে হলেও শিশুকে মিথ্যা বলা যাবে না। আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেছেন......'। এখানে তিনি একটা বড়সড় আয়াত সূর করে তেলাওয়াত করবেন। মোফাচ্ছেরে কোরআন হয়েছেন বলে অনেকে মনে করে তিনি কোরআনের সব আয়াত আর তার বিশ্লেষণ মাথায় নিয়ে ঘোড়েন। অথচ বাস্তবতা হল কিছুদিন না দেখলেই তিনি অনেক আয়াতেরই কিছু অংশ ভুলে যান। এটা অবশ্য তেমন কোন সমস্যা না। বয়ানের প্রতিটা টপিকের উপর তার লেখা খাতা আছে। মাজিদ মুনওয়ার টেবিলের ড্রয়ারের অনেকগুলো খাতার মধ্য থেকে সাদা কভারের একটা খাতা বের করেন। খাতাটার উপরে লাল মার্কার দিয়ে লেখা ' শিক্ষাব্যবস্থা '। এখানে তিনি শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত আয়াতগুলো টুকে রেখেছেন। আয়াতগুলো থেকে উপযুক্ত কয়েকটা আয়াত বের করে তিনি নোট করে রাখেন। উপরে ডাবল কালিতে মোটা করে লেখা ' দলকে বেশি করে প্রমোট করতে হবে ' লেখাটা মাজিদ মুনওয়ারের চোখে পড়ে। তিনি ঠিক করেন বয়ানের এই পর্যায়েই দলকে প্রথমবারের মত প্রমোটের ব্যবস্থা করবেন, বলবেন,' সুতরাং এই শিক্ষাব্যবস্থা পাল্টানোর চেষ্টাটা কিছু লোক করছেন নাকি করছেন না ? কিছু লোক আল্লাহর রাস্তায় কাজ করে যাচ্ছেন কি না? একটি দল ইসলামের পথে আছে নাকি নাই ? আপনারা ইসলামের পথে আছেন নাকি নাই?' । আশা করা যায় এ প্রশ্নগুলোর উত্তর সবাই হ্যাঁ বাচকই দেবে এবং এর পরপরই তিনি বলবেন,' তাহলে আপনারা সেই দলটার সাথে থাকতে রাজী আছেন তো? কারা কারা রাজী আছেন একটু হাতটা উপরে তুলে দেখান তো '। লোকলজ্জার খাতিরেই হোক অথবা বয়ানকারীর চোখের রোষ আটকাতেই হোক প্রায় সবাই হাত তুলবে। তখন তিনি উচ্চস্বরে বলবেন,' মাশাল্লাহ '। এতবড় একটা মাহফিল থেকে দুই চার দশটা লোক যদি দলে না আসে তবে মাহফিল করেই বা লাভটা কি? মাজিদ মুনওয়ার যখন একথা ভাবছেন তখন দরজার কলিংবেলে আওয়াজ হয়। হাজেরা এসে খবর দেয় স্থানীয় লোকজন নাকি এসেছে কিছু, তার সাথে দেখা করতে চায়। মাজিদ মুনওয়ার খুশি হন। মোহাম্মদপুরের এই বাড়িটা তিনি নতুন কিনেছেন। এলাকার লোকজনের সাথে আস্তে আস্তে ঘনিষ্টতা বাড়ছে। অবশ্য এই পরিচয়ের জন্য তাকে খুব বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে না। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সেই ইসলামিক স্কলার হিসেবে সমঝদারদের মধ্যে তিনি একটা জায়গা করে নিতে পেরেছেন। শহরের অনেক অডিও-ভিডিওর দোকানে তার বয়ানের ভিডিও বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। কাঁটাবন মোড়ের কাফেলা ইসলামিক মাল্টিমিডিয়া সেন্টারের মালিক তো তাকে আগাম টাকাই দিয়ে রেখেছেন বয়ানের কপিরাইট হিসেবে। এছাড়া পার্টির টেলিভিশন চ্যানেলে নিয়মিত বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহন করছেন, শুক্রবার জুম্মার নামাজের পরের এক ঘন্টা তো তার ' ইসলামিক সওয়াল ও জবাব ' অনুষ্ঠানের জন্য বাঁধা। এসব অন এয়ারে যাচ্ছে নিয়মিত , কখনো কখনো পুনঃপ্রচারও হচ্ছে। সুতরাং একটা এলাকায় নতুন আসলে পরিচয়ের জন্য কষ্টটা তাকে করতে হবে কেন? ড্রয়িংরুমে বসে থাকা ছেলেগুলোর দিকে তাকান মাজিদ মুনওয়ার। অধিকাংশের বয়স আঠারো থেকে চব্বিশের মত হবে। তিনি ধারনা করেন কোন পাবলিক প্রোগামে তাকে অতিথি করার জন্যই হয়ত এরা এসেছে। মাজিদ মুনওয়ারকে দেখে এরা সবাই দাড়িয়ে পড়ে ও হাল্কা স্বরে সালাম দেয়। তিনি তাদেরকে বসতে বলে তাদের আসার কারন জানতে চান। দলের মধ্যে যাকে দেখলে সবচেয়ে বড় মনে হয় সে বলে, ' হুজুর, আমরা নববর্ষ উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করব পুলিশ ফাঁড়ির সামনের খেলার মাঠটাতে, চাঁদা চাইতে এসেছি সবার কাছে '। ' নববর্ষ ' শব্দটা মাজিদ মুনওয়ারের কানের মধ্য দিয়ে ঢুকে ঠিক যেন কলিজায় গিয়ে আঘাত করে, শব্দটা শুনলেই তার আসমা খানের কথা মনে পড়ে। বকশীবাজার আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ার সময় তিনি যখন নান্নুর হোটেলে বিকেলে সিংগারা-পুরী এসব খেতেন তখন ঠিক ঐ সময়টায় নিয়ম করে হাজী বিস্কুট এন্ড কোং এর স্বত্বাধিকারী মোফাজ্জল খান হাজীর মেয়ে আসমা খান হেঁটে যেত হোটেলের সামন দিয়ে। হয়ত প্রাইভেটই পড়তে যেত। বিশ বছরের যুবক মাজিদ মুনওয়ার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে জুল জুল করে আসমা খানকে দেখতেন। আসমা খানকে কখনো তার লাল কৃষ্ণচূড়া মনে হত , কখনো রজনীগন্ধা, কখনো বা লালপদ্ম। আসমার ফেরার পথেও তাই তিনি দাড়িয়ে থাকতেন নান্নুর হোটেলের সামনে। কিন্তু মাজিদ মুনওয়ারের এই লাল কৃষ্ণচূড়া ধরা হয় নি। সেবার পয়লা বৈশাখে বমনার বটমূলে আসমা খানকে তিনি দেখেছিলেন ছত্তিশ নম্বর বংশাল রোডের সাইকেল ব্যবসায়ী রমিজ সরকারের ছোট ছেলে রফিক সরকারের সাথে। পয়লা বৈশাখ অথবা নববর্ষ শব্দগুলো শুনলে তাই মাজিদ মুনওয়ারের মনটা খান খান হয়ে যায়, রমনার বটমূলে আসমা খানের রফিক সরকারের হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো তার চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। তার পুরো ক্ষোভটা অন্যায়ভাবে গিয়ে পড়ে নববর্ষের উপর, যেন সেবার নববর্ষের এই অনুষ্ঠানগুলো না থাকলে আসমা খানকে আপন করে পেতে তার কোন সমস্যাই হত না। মাজিদ মুনওয়ার ব্যক্তিগত ক্ষোভের পরিধি হতে নববর্ষকে কিছুতেই আলাদা করতে পারেন না। কে জানে এই ক্ষোভের কারনেই হয়ত তিনি নববর্ষের আগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নববর্ষকে হিন্দুয়ানী অনুষ্ঠান বলে তুলোধুনো করেন। তিনি ভাবেন এই ছেলেগুলো এসে ভালই হয়েছে, সামনে যে একটা নববর্ষ আছে এটা তার স্মরণে ছিল না। নববর্ষর ব্যাপারটাও পয়েন্ট আকারে লিখতে হবে। মাজিদ মুনওয়ার তার ভাগের চাঁদার টাকাটা ছেলেদের দিয়ে দেন। এলাকার ছেলেপুলে, প্রথমেই এদেরকে বাঁধা দিয়ে ক্ষ্যাপানো ঠিক হবে না। কিছুদিন আগে হাত করতে হবে, পরে দু-একদিন ঝেড়ে বয়ান দিলেই এরা লাইনে আসবে। এরকম তিনি বহুত দেখেছেন। ছেলেগুলো টাকা নিয়ে চলে গেল। মাজিদ মুনওয়ার আবার লিখতে বসলেন। তিনি পয়েন্ট করতে থাকলেন, বলবেন, ' ভাইয়েরা আমার, সামনে নববর্ষ। ঢাকার ভদ্রলোকরা কি করবে জানেন ? সকালে এরা রমনার বটমূলে যাবে, যুবক-যুবতীরা ঢলাঢলি করবে, আর কিছু শিল্পী গলা ছেড়ে গাইবে ' এসো হে বৈশাখ, এসো ,এসো......' । এরা নাফরমান,নাদান। নববর্ষ একটা হিন্দুয়ানী অনুষ্ঠান। আল্লাহতায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন আর আমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এই প্রকৃতি। আমরা আল্লাহর গোলাম আর প্রকৃতি আমাদের গোলাম। বৈশাখ আসবে বলে তাকে ফুল-ফল আর পান্তাভাত দিয়ে আরাধনা, তাকে বরণ করে নেয়ার জন্য সমস্থ অনুষ্ঠাননাদি সবই ইসলাম ধর্মের বিরোধী। এসবই এসেছে হিন্দুদের পূজা-অর্চনা থেকে। আমাদের পবিত্র ধর্মে এসবের কোন স্থান নাই। যদি কেউ এসবের মধ্যে থাকে তবে সে পরকালে কঠোর শাস্তির ভাগীদার হবে '। কথাগুলো তিনি বলবেন যতটা না জোরে তার চেয়েও জোরে বলবেন,' সুতরাং আপনারা এবার নববর্ষের কোন অনুষ্ঠানে কেউ যাবেন?'। সবাই সমস্বরে ‘ না ‘ বললে তিনি বলবেন,' আলহামদুলিল্লাহ ' । মাজিদ মুনওয়ার তার ড্রয়ারের খাতাগুলোর মধ্য থেকে আরেকটা খাতা বের করেন। এটাতে মোটা লাল মার্কারে ' ইংরেজী ' কথাটা লেখা আছে। ইদানিং তিনি মাহফিলে দু-চারটা ইংরেজী বাক্যও বলছেন, মানে যতটা সম্ভব বলতে চেষ্টা করছেন। যারা ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত,হুজুর দেখলেই নাক সিটকায়, মাহফিলের আশেপাশে থাকলে এরা বুঝুক। বুঝুক তিনি হেজিপেজি বা ফেলনা লোক নন, দুচার লাইন ইংরেজীর বিদ্যাও তার পেটে আছে। অবশ্য ইংরেজীগুলো শিখতে তাকে একটু কষ্টই করতে হচ্ছে। তার এক পুরনো বন্ধুকে বাংলা লিখে দিয়ে সেগুলোর ইংরেজী তরজমা তিনি লিখে নিয়েছেন এই খাতাটায়। ঘুরে ফিরে প্রতিটা মাহফিলেই এগুলোর কয়েকটা করে বলেন। অবশ্য এই ইংরেজীগুলোও বলতে তাকে কিছুটা বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়। আবারও কিছু নির্জলা মিথ্যা গল্প বানাতে হয়। গত মাহফিলের ইংরেজীটা তার বেশ পছন্দের। তিনি বলেছিলেন, ' দেশে মূর্খ লোকজনে ভর্তি। ঠিক উচ্চারণে বিসমিল্লাহ বলতে পারে না অথচ হুজুদের এসে জ্ঞান দেয়। সেদিন এক মাহফিলে পেয়েছিলাম একটা এরকম। আমার মাহফিলে এসে সে হুজুরদের বলছে হুজুররা এটা করবেন না, সেটা করবেন না। আমি তাকে বললাম ,' আপনি কে? হু আর ইউ'। সে বলে সে ঐ এলাকার চেয়ারম্যান। আমি তাকে বললাম,' সো ব্লাডি হোয়াট? গেট আউট অফ দিস ষ্টেজ। আমরা চেয়ারম্যানদের পুছি না। এলেম নাই হুজুরদের জ্ঞান দিতে আসছেন। হুজুরদের জ্ঞান দিতে হলে সেটা দেবেন হুজুররা, আলেমরা। আপনি জ্ঞান দেয়ার কে? ' । ' সো ব্লাডি হোয়াট ' গালিটা মাজিদ মুনওয়ারের বেশ মনে ধরে। এটাকে তিনি আবার ব্যবহার করতে চান। খাতাটা থেকে তিনি আরেকটা বাক্য টুকে নেন। বেশ কয়েকবার প্রাকটিস করতে হবে বাক্যটা। বাক্যটা তার মাথায় ঘুরতে থাকে ' ইন্ডিয়ানদের কখনো বিশ্বাস করবেন না, জাষ্ট লাইক দেয়ার ওল্ড ফাদার দে আর অলসো গোইং টু হেল এন্ড অলওয়েজ ট্রায়িং টু মেক আওয়ার লাইফ হেল'। মাজিদ মুনওয়ার চোখ বন্ধ করে বিড়বিড়িয়ে বাক্যটা আওড়াতে থাকেন। ' ব্লাডি ইন্ডিয়ান' দের নিয়ে কোন গল্পটা ছাড়বেন সেটা ভাবতে ভাবতে তিনি ঝিমিয়ে পড়েন। ' দলকে বেশি করে প্রমোট করতে হবে' কথাটা তার স্মরণ হয়। ব্লাডি ইন্ডিয়ানদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে কেন একটা দলই করতে হবে তার যুক্তি খুঁজতে খুঁজতে তিনি এই অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েন।
- আসসালামুআলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম সালাম।
-মাজেদ ভাই কইতায়াছেন।
বুধবার, ১৫ এপ্রিল, ২০০৯
আমার কাচের শরীর তাদের কথার তাসে বারবার যেভাবে ভেঙে পড়ে
তারা শুধু বলে যায়, কখনও আমি শুনি, কখনও আমরা। এমনটা নয় তারা এইসব বলে গেলে কারও কিছু আসে যায়, শুধু আমার কাচের শরীর তাদের কথার তাসে বারবার ভেঙে যায় ।
শুক্রবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০০৯
একটি উত্থান-পতনের গল্প
অনেকদিন পর শহীদ কাদরীর "একটি উত্থান-পতনের গল্প " কবিতাটা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে । আমি বুঝতে পারি আমার সময় এসেছে , একটি আত্নজীবনীমূলক ব্লগে লেখার সময় এসে পড়েছে । আগে কাদরীর কবিতাটিতে একটু চোখ বুলিয়ে নিন একটি উত্থান-পতনের গল্প শহীদ কাদরীর এই কবিতাটা মনে হলে আমারও বাবার কথা মনে হয়। আমার বাবা মফস্বল কলেজের শিক্ষক , সাবদার রহমান সরকার । সকালে ঘুম থেকে উঠে চা খেতে বের হন ,মোড়ের চায়ের দোকানে আড্ডা বসান বন্ধুবান্ধবদের সাথে । পুরোদস্তুর ফিটফাট হয়ে মোটরবাইকে রাস্তার ধূলা উড়িয়ে কলেজে যান। ধূলারা যেন তার শত্রু ,উড়ে যাতে চায় চারপাশে । আমি তার ছেলে ইমরুল কায়েস , এখন পর্যন্ত শেখা হয় নি সাইকেলে চড়া , সাঁতারও জানি না। আমার বাবা কলেজ থেকে ফিরে বাইকে করে গ্রামে যান , নিঁখুত চাষার মত আবাদ করেন শষ্যক্ষেত্র , মাছের চাষ করেন পুকুরে , শ্যালো মেশিনের পাহারাদারকে শাসান , ক্ষেতের কৃষকরা অনিয়ম করলে কেঁপে ওঠে । অদ্ভুদ প্রাণশক্তিতে পরিপূ্র্ণ একজন মানুষ তিনি । আমি তার ছেলে , আপাদমস্তক অলস , হতাশ আর বিভ্রান্ত এক যুবক । ঘুমাই সারাদিন , বাইরে বেড়োই কম , হাঁটি আরো কম ,পা ব্যথা করে ,ঘরের এক কোণে বসে পড়া মুখস্ত করি আর ভার্চুয়াল জগতে রাজা উজীর মারি । বাবা অল্পবয়সে নৌবাহিনীতে ঢোকেন , পালিয়েও আসেন একসময় । পালিয়ে এসে কলেজ ঢোকেন , বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন । চ্যালেন্জ নিতে উনি ভালবাসেন। আমি তার ছেলে , আমিও পালাই । কলেজে পালাই , বিশ্ববিদ্যালয়ে পালাই ,পড়াশুনা আমার ভাল লাগে না । পালিয়ে গিয়ে কোথাও মাসখানেক থাকব এমনটা আর হয় না , পালিয়ে আবার বাড়িতেই যাই । সুবোধ ছেলের মত দুই দিন পর বাড়ি থেকে ফিরে আসি , আবার পড়া মুখস্ত করতে বসি । চ্যালেন্জ মোকাবেলায় আমার বড় ভয় । চ্যালেন্জরা যেন একেকটা বিরাটাকার বিড়াল , আমি তাদের কাছে ইঁদুরদের মত মুষড়ে পড়ি । আমার বাবা রাজনীতি করেন , প্রতিরাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে এগারো-বারোটায় ফেরেন । রাজনীতির মাঠে তার প্রতিপক্ষ আছে , দাঙ্গা-হাঙ্গামার ভয় আছে । আমি তার ছেলে নিতান্ত সাধারণ , দেশ-দশের নেতৃত্ব তাকে দিয়ে হবে না । আমার কোন প্রতিপক্ষ নেই । প্রতিপক্ষকে আমি ভয় পাই , কেউ পতিপক্ষ হতে চাইলে আমি বাঁধা দেই , আমার দাঙ্গা-হাঙ্গামার বড় ভয় । হলের গেটে কেউ মার খেলে আমি চারতলা থেকে লাইট বন্ধ করে দেখি , নিচ থেকে আসা লাঠির শব্দে আমার আমার অন্তরাত্না কেঁপে ওঠে । মারা শেষ হয়ে গেলে তারা যখন উপরে একটা মাথা দেখে আর অন্ধকারকে উদ্দেশ্য করে বলে 'এই উপরে কে দেখে ?' , আমি তখন সরে যাই , আমার মনে হয় এখনই না সরলে কেউ একজন এসে মারতে শুরু করবে আমাকে । আমি মারামারি আর হট্রগোল বড় পাই । এই আমি তেইশ বছরের যুবক ইমরুল কায়েস আপাদমস্তক ভীতু , আজন্ম কাপুরুষ । আমার বাবার নিয়ন্ত্রন যোগ্য মানুষের কখনও অভাব হয় না । তিনি যখন কাউকে বলেন 'যাও অমুকটা করে আস' , তখন তারা প্রবলভাবে দৌড়ায় , তাদের দৌড় দেখলে মনে হয় তারা যেন শয্যাগত প্রায় মৃত আত্নীয়ের জন্য 'ও নেগেটিভ' রক্তের খোঁজে দৌড়াচ্ছে ব্লাড ব্যাংকে । আমার এরকম নিয়ন্ত্রনযোগ্য মানুষ কখনও হয় না । আমিও যদি বলি 'যাও অমুকটা করে আস' তখন যাকে বলি সে হয় শুনতে পায় না অথবা অনেক পড়ে বলে 'কি বলেছিলে ভুলে গেছি'। আমি তাদের এরকম ভুলে যাওয়া মেনে নেই , মানুষই তো ভুলে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ! আমার বাবার কন্ঠে যেন ইস্রাফিলের শিংগার মত আওয়াজ । একবার যখন তিনি বলেন 'না' তখন চারপাশ যেন গমগম করে উঠতে থাকে , তারাও বলতে থাকে 'না,না, কিছুতেই না ' । আমি সচরাচর না বলি না । না বলতে আমার ভয় হয় । যদি পারতপক্ষে কখনও 'না' বলি , আমার বছরময় সর্দিভেজা গলা বেয়ে উঠতে তার প্রাবল্য কমে আসে , 'হা' এর মত শোনায় খানিকটা । যারা শোনে তারা বলে "হ্যাঁ ঠিকই বলছ ,এই বিষয়টা না হওয়ার কোন কারন নেই'। আমার বাবা রোমান্টিসিজমে বিশ্বাস করেন । যুবক বয়সে তিনি মন দেয়া নেয়া করেন যার সাথে পরিনত বয়সে তাকেই বিয়ে করেন । রোমান্টসিজমের আতিশয্যে তিনি লেখেন ডায়েরি '"শেফালী নামের মেয়েটি " । সে ডায়েরী পড়লে যে কেউ তাকে রোমান্টিক একটা উপন্যাস বলে চালিয়ে দিতে পারে । আমি তার ছেলে , পুরোটাই যান্ত্রিক ,তেইশ বছর নারীসঙ্গবিহীন , তেইশ বছর নারীস্পর্শবিহীন ,ঘড়ির কাঁটাকে সব বুঝিয়ে দেয়া যুবক। তাদের দেখলে আমার রুক্ষ কন্ঠ আরো রুক্ষ হয়ে ওঠে , হাত পা কেঁপে ওঠে ভয়ে । তাদের কেউ একজন কোন এ সময় বলে ওঠে 'ইওর ভয়েস ইজ ভেরী হার্শ' । আমার রোমান্টিসিজমে আক্রান্ত হতে বড় ভয় হয় । আমার বাবাকে আমার একটি প্রাচীন বটগাছ বলে মনে হয় , অনেকেই তার ছায়ায় থাকে , অনেকেই তার ছায়ায় থেকে খুশি হয় । আমার নিজস্ব কোন ছায়া নেই ,আমি কাউকে ছায়া দিতে পারি না । অন্যের ছায়ায় থাকতেই আমি অভ্যস্ত, ছায়া সরে আমি বিপদাক্রান্ত হই । পরগাছা হয়ে আমি বটগাছকে জড়িয়ে ধরতে ভালবাসি । আমার বাবা উত্তর বাংলার এক সময়কার সাহসী যুবক , বর্তমান সময়ের এক কর্মঠ আর প্রানবন্ত মানুষ । আর আমি তার ছেলে জন্ম-জন্মান্তর থেকে নুয়ে আসা মানুষ, উত্তর বাংলার এক আহত যুবক । শহীদ কাদরীর মত আমারও বলতে ইচ্ছে "আমি"- ছোটো,বেঁটে - ঝোড়ো নদীতে
শহীদ কাদরী
আমার বাবা প্রথমে ছিলেন একজন
শিক্ষিত সংস্কৃতিবান সম্পাদক
তারপর হলেন এক
জাঁদরেল অফিসার ;
তিনি স্বপ্নের ভেতর
টাকা নিয়ে লোফালুফি খেলতেন
টাকা নিয়ে ,
আমি তাঁর ছেলে প্রথমে হলাম বেকার ,
তারপর বেল্লিক
তারপরো বেকুব
এখন লিখি কবিতা
আমি স্বপ্নের ভেতর
নক্ষত্র নিয়ে লোফালুফি করি
নক্ষত্র নিয়ে ;
--------
-------
বাবা যখন-তখন যাকে-তাকে চপেটাঘাত করতে পারতেন ।
আমি কেবল মাঝে-মধ্যে একে-ওকে চুম্বন ছুঁড়ে মারতে পারি ,ব্যাস !
প্রবল বর্ষার দিনে বাবা
রাস্তায় জলোচ্ছ্বাস তুলে স্টুডিবেকারে ঘরে ফিরতেন,
আমি পাতলুন গুটিয়ে স্যান্ডেল হাতে
অনেক খানাখন্দে পা রেখে এভিনিউ পার হ'তে চেষ্টা করি
বাবার নাম খালেদ-ইবনে-আহমাদ কাদরী
যেন দামেস্কে তৈরী কারুকাজ-করা একটি বিশাল ভারী তরবারী,
যেন বৃটিশ আমলের এখনও-নির্ভরযোগ্য কোনো
ঝনঝন ক'রে-ওঠা ওভারব্রীজ ,
আমার নাম খুব হ্রস্ব
আমার নাম শহীদ কাদরী
ছোটো,বেঁটে - ঝোড়ো নদীতে
কাগজের নৌকার মতই পলকা
কাগজের নৌকার মতই পলকা ।
কাগজের নৌকার মতই পলকা
কাগজের নৌকার মতই পলকা ।