রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০০৮

খাম

অনেকদিন পর রাতে পুরনো ডায়েরিটা পড়ছিলাম । বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ডায়েরী।বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ডায়েরী লেখাকে একটা অভ্যাসে পরিনত করেছিলাম । স্বাভাবিকভাবেই নানান নষ্টালজিক ঘটনায় ঠাসা ডায়েরীটা। সেগুলোই এতদিন পর পড়ছিলাম।ডায়েরীর ভিতর একটা খাম পেলাম । সাদা,ছোট্র একটা খাম।খামের গায়ে আকাশী বর্ণের দু-তিনটি মিকিমাউস টাইপের কার্টুন আঁকা । আমি খামটি দেখতে থাকি,পরম মমতাভরে হাত বুলোতে থাকি খামের উপর। কেন জানি চোখ ভিজে আসতে থাকে আমার।মাথা নিছু করে ছিলাম।কয়েক ফোঁটা পানি গিয়ে পড়ে আমার চশমাটার উপর। ঝাপসা হয়ে ওঠে চশমাটা। আম্মা রুমে ঢুকে আমাকে ডাকেন কিরে কি হেয়েছে চোখে পানি কেন। আমি চেয়ারে ঝুলানো গামছাটা দিয়ে চোখ আর চশমাটা মুছি।না মাথাটা ব্যথা করছিল তো তাই একটু নিক্স লাগালাম মাথায়,চোখেও গেছে বোধহয় একটু। মিথ্যা কথাটা আমাকে বলতেই হয়। সাবধানে দিবিনা ,আমাকে বললেই হত লাগিয়ে দিতাম। মাথা ব্যথা করছে তো বসে আছিস কেন?আমি লাইট বন্ধ করে দিচ্ছি শুয়ে পড়। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে আম্মা লাইট নিভিয়ে চলে যান।আমি শুয়ে পড়ি।আমার চোখে মনাদের বাড়িটা ভেসে ওঠে।

বেশ বড়ই বাড়িটা।ঢাকা শহরে এরকম বড় বাড়ি খুব একটা চোখে পড়ে না। মেইন গেট পেরিয়ে বড় একটা বাগান পড়ে । বাগানের মধ্যে প্রসস্থ রাস্তাটা দিয়ে কিছুক্ষন হাটলে তবেই মূল দালানের গেটটা পাওয়া যায়। আমি মনাকে ওদের অদ্ভুদ ডিজাইনের বড় বাড়িটা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ও বলেছিলো ওদের দাদার বানানো বাড়ি। ঐতিহ্যের খাতিরে নাকি ভাঙা হয়নি। মনাদের শ্রেনীর লোকেরা ঐতিহ্য খুব পছন্দ করে তাই আমি আর বিশেষ কিছু বলিনি। মনাদের বাড়ীতে আমাকে কয়েকদিন যেতে হয়েছিলো।

/p>

মনাকে আমি পড়াতাম ,খুব বেশীদিন না অল্পদিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মফস্বলের স্কুল শিক্ষক বাবার কাছে কয়েকমাস টাকা নেওয়ার পর মনে হচ্ছিল না অনেক হয়েছে আর না এবার নিজেই কিছু করি। এক বন্ধুর মারফত গেলাম ওকে পড়াতে ঠিক ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার বারোদিন আগে। ফাইনাল রিভিশনের জন্য যাওয়া আরকি।প্রথমদিন মনাদের বাড়ীতে ঢুকতে একটু ভয় হয় আমার। বড়লোকদের বাড়ী,আগে কখনো এরকম বাড়িতে ঢোকা হয়নি। বিশেষত 'কুকুর হইতে সাবধান 'জাতীয় কথাবার্তা আমার জানা ছিল এবং তৎসংক্রান্ত দু একটি ঘটনাও কোথাও কোথাও পড়েছিলাম। তাই বড়লোক সংক্রান্ত আমার একটা ভয় ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেরকম কিছু হয়নি।গেটে একজন দাড়োয়ান দাড়ানো ছিল সে আমাকে আমার নাম আর আসার কারন বলামাত্র দরজা খুলে বাগানের রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়েছিল। হয়ত আগেই বলা ছিল।আমি মনাদের বাড়িটা দেখে অবাক হয়েছিলাম,অবাক হয়েছিলাম ওদের গাড়িগুলো দেখেও। একটা পরিবারের এতগুলো গাড়ীর কি দরকার হতে পারে কিছুতেই মাথায় ঢোকেনি আমার।

/p>

মনাকে পড়ানোমাত্র আমি আবিষ্কার করলাম সে দুনিয়াসম্পর্কিত অনেক সাধারণ জিনিস দেখেনি,বোঝেও না অনেককিছু। মনা কখনো খেজুর রস খায়নি ,চড়েনি নৌকায়ও। কুমড়ার ফুল দিয়ে যে বড়া বানানো যায় তা সে জানতনা। আমি বলার পর সে এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিল যেন আমি একটা কুখাদ্যর রেসিপি দিচ্ছি ওকে। আমি খুবই আশ্চর্য হয়ে জানতে পারি পাটগাছ ও ভুট্রাগাছ নামের যে দুটি অতি পরিচিত গাছ আছে তা মনা কখনো দেখেনি। সে মনে করেছিল ভুট্রাগাছ লিচু গাছের মত বড় কোন গাছ হবে। আমি মেয়েটার কথাবার্তা শুনে হাসি,অবাকও হই। মনার সরলতা আমার ভালই লাগে। নানান বিষয়ে কথা বলতে বলতে সময় গড়িয়ে যায়,পড়ানো হয়ে ওঠে সামান্যই। আমার আর মনার গল্প শেষ হয়না।

/p>

মেয়েদের সাথে আমি আগে এরকমভাবে কখনও মিশিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ওঠার আগে যখন বাড়িতে থাকতাম তখন বলা যায় একরকম এড়িয়েই চলতাম মেয়েদের। মেয়েদের সাথে কথা বলতে কেন জানি রাজ্যের লজ্জা ভর করত আমার ওপর। আম্মা ব্যাপারটা জানতেন তাই হল থেকে যখন ছুটিছাটায় বাড়িতে যেতাম তখন জিজ্ঞাসা করতেন কি রে কোন বান্ধবি -টান্ধবি হল। আমি আম্মার কথাটার মানে বুঝতাম আর একটু মুচকি হেসে বলতাম না,হল না। তাই মনার সাথে অনবরত কথা বলার সময় মনার মাঝে মেয়েদের নতুন করে আবিষ্কার করতে থাকি আমি। কথা বলার সময় মনা অকারনে খিলখিল করে হেসে ওঠে। কোন ছেলেবন্ধু হলে আমি নিশ্চিত বিরক্ত হতাম কিন্তু মনার এরকম অসংযত,অকারন হাসি আমার ভালো লাগে,এক ধরনের ভাললাগা তৈরী হতে থাকে মনার জন্য ,আগে যা কখনও হয়নি কোনো মেয়ের জন্য। আমি বুঝতে পারি আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি,কিন্তু এ দুর্বলতা আমি ঠেকাতে পারিনা।আমার খারাপ লাগতে থাকে। আমার অবস্থাগত কারনে দুর্বল হওয়ায় আমার খারাপ লাগতে থাকে,খারাপ লাগতে থাকে ছাত্রীর প্রতি দুর্বল হওয়াতেও। আমি নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকি।

/p>

বারোদিন পড়ানো হয়ে গেলে মনা আমাকে সাদা খামটি দেয়। বলে ভাইয়া আম্মু দিয়েছে। এর আগে আমি কখনো পড়ানো বাবদ খামভর্তি টাকা নেইনি। একটু বিব্রতবোধ হয় আমার। চট করে খামটি সামনের পকেটে রাখি।মনাকে আর পড়ানো হবেনা,হয়ত দেখাও হবেনা কখনও ভাবনাটা মাথায় চেপে থাকে । মনটা ভারী হয়ে ওঠে আমার। যন্ত্রের মত পড়াই আমি,কোন গল্প হয়ে ওঠেনা সেদিন। পড়ানো হয়ে গেলে আমি বলি মনা আজকে তাহলে যাই,ভালোভাবে পরীক্ষা দিও। মনা বলে, আচ্ছা। আমি মনার কিছু বলার জন্য বৃথা অপেক্ষা করতে থাকি। মনা কিছু বলেনা,চুপ করে থাকে,ফোন আসে ফোন ধরে কথা বলতে থাকে। আমি বসেই থাকি,কেন জানি যেতে ইচ্ছে করেনা। মনা ফোন কেটে দিয়ে আমার দিকে তাকায়,আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। আমি বসে আছি কেন মনার তো কিছু বলার কথা নয়,কেউ একজন ভিতে থেকে আমাকে নাড়া দেয়।আমাকে উঠতেই হয়। আমি বলি ঠিক আছে গেলাম। দরজার দিকে পা বাড়াই আমি,মনাও দেখি দরজা পর্যন্ত আসে।আমার বুকের ভিতরটায় ধক করে ওঠে,আমি দরজায় গিয়ে দাড়াই। মনা কি কিছু বলবে,আশান্বিত আমি চেয়ে দেখি মনার দিকে।মনা বলে ভাইয়া দোয়া করবেন,চান্স পেলে খাওয়াব।আমি বলি হ্যাঁ দোয়াতো করবই। দরজার সামনের লনটাতে পা বাড়াই আমি।

মনাদের বাড়ী থেকে এই একটি খাম নিয়ে আমি ফিরে আসি। মনার সাথে আমার আর কখনও দেখা হয়নি। এই পৃথিবীতে কেইবা কাউকে মনে রাখে!মাঝে মাঝে আমি খামটা বের করে দেখতাম। মনার কথা চিন্তা করতাম,কেমন আছে বোকা মেয়েটা! আমি হয়ত তখনও বুঝিনি মনার কাছ থেকে এই একটিমাত্র খামের বেশী আর কিছু পাওয়ার যোগ্যতা আমার ছিল না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন