রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০০৮

কুয়াকাটা-০১

[১] বুয়েটে এক শিডিউলে পরীক্ষা খুব কম সময়েই হয়েছে । এবারও তাই হল। ঈদের আগে একটামাত্র পরীক্ষা ছিল । এটাও নাকি দেয়া যাবে না । মিছিল হল দুইদিন । পরীক্ষা পিছাও , পরীক্ষা পিছাও আওয়াজ । আর বুয়েটের স্টুডেন্ট সবাই জানে এরকম মিছিল হলে পরীক্ষা আর হয় না । এবারও হল না। মাসখানেকের বন্ধ পেয়ে মনে হল এইবারে একটু কোথাও থেকে ঘুরে আসা যাক। সেই কবে একবছর আগে বান্দরবন-বগালেক গিয়েছিলাম এরপর এই এক বছরে শুধু খাওয়া-পড়া-ঘুম আর খাওয়া-পড়া-ঘুম । এই চক্র থেকে বের হতে হবে বলে মনস্ত করলাম । সিদ্ধান্ত হল কুয়াকাটা যাব । কুয়াকাটায় আগে কখনো যাওয়া হয় নি । এখানে নাকি সূর্যাস্ত-সূর্যোদয় দুটোই দেখা যায় । যতদূর চোখ যায় পানি ছাড়া আর কিছু নেই এমন একটা জায়গা থেকে আস্তে আস্তে সূর্য উঠবে আবার সারাদিন গরম ছড়িয়ে পড়ন্ত বিকেলে এই রকমই আরেকটা জায়গা দিয়ে আস্তে আস্তে নামতে নামতে একসময় পানির মধ্যে হারিয়ে যাবে এরকম দুটি দৃশ্য কল্পনা করতেই ভাল লাগছিল ।এ দৃশ্য দেখার জন্য খুব বেশী দেরী করতে হল না । বলামাত্র আরও পাঁচজন রাজী হয়ে গেল । সুন্দরবন-৫ এর কেবিনে শুক্রবার সন্ধ্যায় আমরা ছয়জন চেপে বসলাম ।

[২] লঞ্চে আগে কখনো চড়া হয় নি । সাঁতারও জানি না । সাঁতার শেখার চেষ্টাও করিনি জীবনে । সারাবছরে যে হারে লঞ্চ ডোবে এর আর ভরসা কি ? লঞ্চে উঠে আমি তাই কেবিনের আশে-পাশে সবার অলক্ষ্যে লাইফ জ্যাকেট জাতীয় কিছু খুঁজে বেড়ালাম । এরকম কিছু পেলাম না । কেবিনের দরজার সামনে অবশ্য যানবাহনের টায়ার টাইপ একটা জিনিস দেখতে পেলাম । ভাবলাম যাক এটা দিয়ে অন্তত ভেসে থাকা যাবে ।অন্য পাঁচজন যখন কেবিনের সামনে আড্ডাকেবিনের সামনে আড্ডাকেবিনে আড্ডায় মশগুল আমি তখন এই টায়ার জাতীয় জিনিসটা খোলার চেষ্টা করলাম এবং যারপরনাই হতাশ হলাম ।এখন যদি এটা খোলা না যায় লঞ্চ ডোবার ক্রান্তিকালে এটা কিভাবে খোলা যাবে ভেবে পেলাম না । কুয়াকাটায় বীচে গিয়ে দেখেছি একটা ফুটবল নিয়ে আরামসে পানির মধ্যে ভেসে থাকা যায় । আগে জানলে এদের উপর আর ভরসা না করে নিজেই ব্যাগের মধ্যে একটা ফুটবল নিয়ে আসতাম ! জীবন বলে কথা । ফুটবল পাওয়া কঠিন কিছু হত না । হলের পোলাপাইনের কাছে বিকেলে খেলার জন্য এমনিই ফুটবল থাকে ।

রাতের লঞ্চভ্রমন অদ্ভুদ লাগে । চারিদিকে শুনশান নীরবতার মধ্যে মৃদু শব্দ তুলে লঞ্চটা এগিয়ে যায় । কেবিন পেরিয়ে সামনে লঞ্চের সার্চলাইট , মাঝে মাঝে সেটা জ্বলে ওঠে । লঞ্চের সার্চইটের পাশেলঞ্চের সার্চইটের পাশেএদিক ওদিক ফোকাস করে নদীরে বুক চিরে আলো ফেলে । হু-হু করে মৃদু ঠান্ডা বাতাস এসে চরিদিক ভরিয়ে দেয় । সোজা কথায় বলতে গেলে এক অপার্থিব পরিবেশ ।

[৩] কুয়াকাটা যাওয়ার আগে এক সুশীলের পরামর্শ নিলাম । সে আমাকে বলল লঞ্চে যাবতীয় খাবারদাবার আগে থেকেই এনে রাখবি । লঞ্চের ডিনারের অবস্থা খুব খারাপ আর দামও বেশী সো বেশী টাকাপয়সা দিয়ে খাবাপ খাওয়ার কি দরকার ? আমি এই কথাটা সবার কাছে পাড়লাম । সদরঘাটে রিক্সা যখন পুরান ঢাকা দিয়েই যাচ্ছে সুতরাং ওখানকার কোন দোকান থেকেই রাতের খাবার হিসেবে মোরগ-পোলাও অথবা বিরিয়ানী নিয়ে যাওয়া হোক । কেউ কথাটায় খুব একটা গা করল না , সবাই নাকি লঞ্চের খাবারই খাবে । সুশীলের পরামর্শ কেউ শুনল না । অগত্যা আমি আর এক কুশীল এই দুই কুশীল মিলে পুরান ঢাকার একটা দোকান থেকে মোরগ পোলাও কিনলাম । আমি আবার মোরগ পোলাওয়ের সাথে গরূর মাংসও আলাদা করে কিনলাম । শালারা কথা শুনলি না , লঞ্চে ফালতু খাবার যখন তোরা খাবি তখন দেখিয়ে দেখিয়ে আমরা দুজন এসব খাব । পোলাওয়ের দোকানদারকে বললাম ভাই খাবারগুলো রাত দশটার দিকে খাওয়া হবে সমস্যা তো নাই নাকি ? সে বলল ছমছ্যার কি আছে ? সমস্যা অবশ্য হল , কিছুটা না , সমস্যা ভালই হল ।

রাতে দেখি লঞ্চে খাবারদাবারের বিশাল আয়োজন । দেশী মুরগীর ঝোল , সব্জি , ডাল চচ্চরী । ঘরোয়া রান্না সব । পরিবেশনের সময়ই বোঝা যাচ্ছিল খাবারের কোয়ালিটি বোধহয় ভালই ,অন্তত সুশীল বর্ণিত কুখাদ্য নয় । আমরা দুইজনও আমাদের বাক্স-পেটরা থেকে মোরগ-পোলাও বের করে খাওয়া শুরু করলাম । কুশীল বন্ধু সবাইকে শুনিয়ে পোলায়ের নানান গুনগান গাওয়া শুরু করল । কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম কেস খারাপ । পোলাও টক-টক লাগে কেন ? আমি তাকে কানে কানে বললাম আস্তে চাপা কম পিটা সমস্যা আছে । গরূর যে মাংসটা নিয়েছিলাম গন্ধটা বেশী উঠেছিল বোধহয় তাতেই । আমি তাই বলতে গেলে বসেই আছি খাবার নিয়ে । এখন কি করা যায় । এমন সময় কেবিনে আরেক কুশীল ঢুকল যে এতক্ষন বাথরুমে ছিল । সে এসেই বলল , কি ব্যাপার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে কিসের ? আমি বললাম মোরগ পোলাওয়ের গন্ধ । সে বলল , না এটাতো পঁচা খাবারের গন্ধ মনে হচ্ছে , দেখ তোদের খাবার পঁচি (এই কুশীলের আবার ক্রিয়াপদে হ্রস্ব ই-কার প্রয়োগের বাতিগ আছে ) গেছে । আমরা বুঝলাম হ্যাঁ গন্ধটা মনে হয় বাড়াবাড়ি রকমেরই উঠেছে । খাওয়া আর গেল না বোধহয় । বাকী সবাই তখন লঞ্চের খাবারের প্রয়োজনের অধিক প্রশংসা শুরু করে দিয়েছে । হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এরা সারাজীবনে এরকম মধুর রান্না আর খায় নাই , যদিও বোঝা যাচ্ছে এই প্রশংসার অধিকাংশই ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে । যাই হোক চিপায় পড়ে আমার দুজন তখন মিনমিনে গলায় ওরা যা খাচ্ছিল সেই খাবারেই অর্ডারই দিলাম । খাবার আসল । খাবার তো ভালই । রান্নায় কোন সমস্যা নাই । খাবারের বাকী পর্বটা ঐ সুশীলকে নিয়ে কুকথা বলেই পার করলাম সবাই ।

[৪] পটুয়াখালী পৌছালাম ভোরবেলায় । লঞ্চঘাটাতেই একটা মাইক্রোবাস পাওয়া গেল । মাইক্রোবাসওয়ালা দেখি পটুয়াখালি থেকে কুয়াকাটা মাত্র আটশো টাকা চায় । বাস ভাড়াই যেখানে প্রতিজনে একশো টাকা করে সেখানে ছয়জনের জন্য কিভাবে সে আটশো টাকা চায় ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল না । মাইক্রোবাসে করে কুয়াকাটার পথেমাইক্রোবাসে করে কুয়াকাটার পথেতার উপরে পটুয়াখালি-কুয়াকাটা রাস্তার বেহাল হাল সবাই জানে । যাই হোক বিষয়টা পরিষ্কার হল একটু পরে । কোন জানি অফিসের মাইক্রোবাস এটা । সকাল দশটার মধ্যে এমনিতেই ওদের কুয়াকাটা যেতে হবে । আমাদের কাছে টাকা-পয়সা যা পাওয়া যাচ্ছে সেটাই ওদের লাভ । সে আমাদের বলে, এ ছাড়া এত সস্তায় কি আর পাইতেন , এই রুটের ভাড়া তো এম্নিতেই পয়ত্রিশশো টাকা । চাপাই কি না কে জানে । আমরা মাথা নাড়ি ও আচ্ছা ! যাই হোক ড্রাইভারেরও লাভ আমাদেরও লাভ । ভাগ্য বটে । পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটার রাস্তাটা যেরকম ভেবেছিলাম তার চেয়ে বেশী খারাপ । কোথাও কোথাও পীচঢালা রাস্তা , কোথাও কোথাও রাস্তার মাঝে ইটের টুকফেরীর অপারেটিং রুমে আমরা দুজন---ভাইজান একটু ফেরী চালাইতাম চাইফেরীর অপারেটিং রুমে আমরা দুজন---ভাইজান একটু ফেরী চালাইতাম চাইরা দিয়ে রাখা আছে হয়ত পীচ ঢালা হবে আর কিছুদিন পর , কোথাও কোথাও রাস্তার মাঝের পীচ বা ইট কিছুই নাই দেখলে মনে হয় কেউ যেন রাস্তাটা প্রবল আক্রোশে খুবলে খুবলে রেখে গেছে । আন্ধারমানিক পার হচ্ছি ফেরীতে করেআন্ধারমানিক পার হচ্ছি ফেরীতে করেযাত্রাপথে ফেরী পার হতে হল তিনটা নদীতে। নদীগুলোর নাম অসাধারণ । একটার নাম আন্ধারমানিক , একটার নাম সোনাতলা । তৃতীয়টা অবশ্য নদী কিনা বোঝা গেল না । খুবই ছোট । নামটাও খালের নামে আলীপুর খাল । দুই-তিনটা ফেরী পাশাপাশী রাখলেই মনে হয় এটা পার হওয়া যেত । তারপরেও এটা একটা ফেরীতেই পার হতে হল । আমাদের মত করে কে আর ভাবে ? কুয়াকাটা পৌছালাম সকাল ১০ টায় । উঠলাম কুয়াকাটা ইনে। ভাল হোটেল । সবার পেট চোঁ- চোঁ করছিল । লাগেজপত্র হোটেলে রেখেই বেড়িয়ে পড়লাম সকালের নাস্তা করতে । সেখানে একটা কান্ড ঘটে গেল । সেটা না হয় আরেক পর্বেই বলি ।

শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০০৮

কুয়াকাটা-০২

[১] কুয়াকাটায় কক্সবাজার বা সেন্টমার্টিনের মত এত ওয়েভ নাই যে ঢেউয়ের তালে তালে নাচা যাবে । আমরা ছয়জন তাই কোমড় পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে খোশগল্প করছিলাম । অধিকাংশই বয়সের দোষে কুশীল আলাপ । এমন সময়ই ভদ্রলোকটির সাথে আমাদের দেখা । সমুদ্রের পানিতে সাঁতরাচ্ছেন আর আমাদের কি জানি বলছেন । কথা ভালমত বোঝাও যাচ্ছে না । শুধু একটাই বুঝলাম হোয়ার ফ্রম ইউ ? আমরা বললাম উই আর ফ্রম ঢ্যাকা । ইউ । তিনি বললেন আই অ্যাম ফ্রম সাইপ্রাস,হ্যাভ ইউ হারড দা নেইম সাইপ্রাস ? সাইপ্রাসে উচ্চশিক্ষার ফেরী করে বেড়াচ্ছে ঢাকার নানান এজেন্সী । পত্রিকা খুললেই বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে "হায়ার ষ্টাডিস ইন সাইপ্রাস "। পড়াশুনা জাননেওয়ালা লোকের তাই সাইপ্রাস শব্দটা না শুনে উপায় নাই । আমরা তাই বলি ইয়েস উই হ্যাভ । মিশ্রিপাড়ায় গৌতমের মূর্তিমিশ্রিপাড়ায় গৌতমের মূর্তিভদ্রলোক এবার আমাদের কাছে আসেন । নানান আলাপ জুড়ে দেন । অধিকাংশই সাইপ্রাসের আলাপ ,ভূমধ্যসাগরের আলাপ । সাইপ্রাস ইজ এ ভেরী নাইস কান্ট্রি নট ক্রাউডেট লাইক দিস কান্ট্রি । এইসব আলাপ আর কি ? আমাদের মেজাজ খারাপ হয় । শালা সাইপ্রাসের গুন গাইতাছস গা , বাংলাদেরশের নিন্দা করছ কির লাইগা ? কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেন আর ইউ স্টুডেন্টস ? আমরা বলি ইয়েস। ফ্রম হয়ার? আমাদের একজন বলে বুয়েট। সে আরও বলে হ্যাভ ইউ হার্ড দিস বিফোর , দিস ইজ বাংলাদেশ ইউনিভারসিটি অব ইন্জিনিয়ারিং টেকনোলজী । ও ইয়া আই হ্যাভ হার্ড দিস ,ইট ইজ বিসাইড ডিএমডিএইচ(ডিএমসি বোঝাইতে চেয়েছে বোধহয়)। আমরা খুশি হই । যাক অন্তত একজন বিদেশীর দেখা পাওয়া গেল যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে চেনে । বিদেশে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালের যে ভাবমূর্তি ! সেদিন চার হাজার টপ লিষ্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা তালিকা দেখলাম । বাংলাদেশের শুধু একটাই বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেখানে । বুয়েট । সেটাও তিন হাজারের পর পরে । প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও কোন অস্তিত্ব নাই চার হাজারের মধ্যে ।যাই হোক ভদ্রলোকের সাথে কথা জমে উঠেছে । কথা জমবেই না কেন ? বিদেশ সম্বন্ধে আমাদের অসীম আগ্রহ আর প্রশ্ন । আমরা নানান প্রশ্ন করছি , তিনি উত্তর দিচ্ছেন আর আমরা ,আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে আমি বিশেষ লাইনে আলাপ জমানোর ধান্ধা করছি। বিশেষ লাইনটা কি নিশ্চয় আর বলে দিতে হবে না । এমন সময় ভদ্রলোক (না ভদ্রযুবক ,ইনার বয়স ত্রিশের মত হবে) আসল কথাটি পাড়লেন অ্যাকচুয়ালী আই অ্যাম এ বাংলাদেশী , লিভিং সাইপ্রাস সিন্স টু থাউজেন্ট ত্রি । নাউ ইন বাংলাদেশ ফর পাইভ অর সিকস মান্থস। আমরা মনে মনে ভাবি ও আচ্ছা ,এইজন্যই তুমি বাংলাদেশের নিন্দা কর এরপর তিনি পরিস্কার কুমিল্লার বাংলা বলা শুরু করলেন । ইনার উপর মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায় । অযথা ইংরাজী কওয়ার কি দরকার । আমরা কি বাংলা বুঝি না ? নাড়িভূরি নিংড়ে ইংরেজী কইতে কি সমস্যাই না হল এতক্ষন । এখন তো ভালই বাংলা বলছেন ।

সন্ধ্যায় এই লোকের সাথে বার দেখা হয় । বীচে সবাই মিলে ছাতার নিচে আর আরামকেদারায় শুয়ে গল্প করতে থাকি । একসময় ভদ্রলোকের সাথে সম্পর্কটা মাইডিয়ার টাইপ হয়ে ওঠে । কথা শুরু হয় মদ আর মেয়ে নিয়ে । আমরা জিগাই কি গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি ? তিনি বলেন হ্যাঁ । সাইপ্রাসের মেয়ে । ওরে ! কত শুটকি রে ।ওরে ! কত শুটকি রে । অতি উৎসাহী হয়ে তিনি তার গার্লফ্রেন্ডের একটা ভিডিও দেখান আমাদের । আমরা বলি ভালই তো । এরপর উনি আরও নানান জাতের মেয়েদের গল্প আমাদের শোনান । টার্কির মেয়েদের গল্প, পূর্ব ইউরোপের পিছনে ছিলমারা মেয়েদের গল্প কি নেই এতে । আমরা অবাক হই ,যারা অবাক হয় না (হয়ত দেশেই অনেক মেয়েদের সাথে দুএকজনের এটা-ওটা আছে!) তারা অবাক হওয়ার ভান করে । আহা! কি আরামেই না ইনারা আছেন । ভদ্রলোক এবার মদের আলাপ শুরু করেন। কতইনা মদের নাম আর কতইনা তার বাহার । আমাদের গলা শুকিয়ে ওঠার জোগার হয় । তিনি আমাদের কাছে জানতে চান কি বিয়ার-টিয়ার চলে নাকি ? আমরা গাঁইগুই করতে থাকি । হ্যাঁ , না , মানে চলে হালকা পাতলা । আমাদের মনে ক্ষীন আশা জাগ্রত হয় । সামান্য বিয়ার বুঝি আজকে গলায় শুটকি না দানবশুটকি না দানব জোটেই । আমরা আরো গল্প জাকিয়ে তোলার চেষ্টা করি । কিন্তু চাইলেই তো আর সব হয় না । আমাদের বিয়ার খাওয়ার আশায় গুড়োবালি দিয়ে এবং ছাতা-আরামকেদারার সামান্যটুকু বিল না দিয়েই তিনি কেটে পড়েন । তাকে নিয়ে বাকি সময়টা কুকথা বলেই কাটে আমাদের ।

[2] কুয়াকাটার আপ্যায়ন নামক রেষ্টুরেন্টটায় কেউ যদি একবার লটপটি খায় এটা স্বীকার করে নেয়া তার কর্তব্য হবে বলে মনে হয় যে এর চেয়ে কুখাদ্য সে সারাজীবনে খায় নি । অনেকে মনে করবেন বাড়িয়ে বলছি কিন্তু আমাদের ছয়জনের এই রেষ্টুরেন্টটায় খেয়ে এটাই মনে হয়েছে । সারারাত জার্নির পর সকালে হোটেলে পৌছেই লাগেজপত্র রেখে বেড়িয়ে পড়লাম ব্রেকফাষ্টের সন্ধানে। যে হোটেলে উঠেছি তার সামনেই একটা রেষ্টুরেন্ট দেখলাম "হোটল আপ্যায়ন" । দেখি বাহিরে চুলায় গরম গরম নান ভাজা হচ্ছে । পেটে সবার ক্ষুধা এত বেশি ছিল যে মনে হচ্ছিল আস্ত এক ডেকচি নান সাবার করে ফেলা যাবে । তাড়াতাড়ি রেষ্টুরেন্টে ঢুকে নান-লটপটির অর্ডার দিলাম । একজন দিল ভাত-মুরগীর অর্ডার। লটপটি-মুরগীর নামে যে খাদ্যবস্তু এল আমি হিসেব করে তার একটা প্রস্তুতপ্রনালী বের করেছি-

একটি ডেকচিতে (হোটেলের রান্না ,বিস্তর লোকজন খাবে ডেকচি তো লাগবেই)পানি নিন । সমুদ্রের পানি হলে ভাল হয় তাতে লবনের খরচটা খানিকটা বাঁচবে । এই পানিতে ফালিফালি করে আলু কেটে দিন যাতে গড়ে প্রতি বাটিতে দুই-তিন ফালা করে আলু পড়ে । এবার এতে লবন-মরিচের গুড়া-তেল-নূন-মসলা ঢালুন । এসব ঢালার সময় খেয়াল রাখবেন এদের পরিমান যেন খুব বেশী না হয় আবার এমন কমও না যে কেউ খেলে বুঝতে পারবে যে এসব কিছুই দেয়া হয় নি অর্থাৎ এমন পরিমান হবে যাতে খেয়ে বোঝা যাবে লাল কাঁকড়ার জন্য খোড়া হচ্ছেলাল কাঁকড়ার জন্য খোড়া হচ্ছেলবন-ঝাল-তেল জাতীয় জিনিসপত্র আছে কিন্তু স্বাদ বোঝা যাবে না । যাই হোক এরপর মিশ্রনটাকে উৎকৃষ্টরূপে জাল করতে হবে যাতে এটা হাল্কা গাঢ় হয় , খুব বেশী গাঢ় করার দরকার নাই জানেনই তো কাষ্টমার ঝোল বেশী খায় , বেশী গাঢ় করতে গেলে ঝোল কমে যাবে । এরপর স্পেসিফিক্যালি ঠিক করতে হবে আপনি কি রান্না করতে চাচ্ছেন । যদি ডিম রান্না করতে চান তবে ডিম সিদ্ধ করে খানিকক্ষন পিঁয়াজ-তেলে ভেজে লাল হয়ে উঠলে তৈরী করে রাখা ঝোলে ছাড়ুন । ব্যস হয়ে গেল ডিম রান্না । কাঁকড়া পাওয়া গেছেকাঁকড়া পাওয়া গেছে লটপটি রান্নার কষ্ট আরও কম । মুরগী ছেলার সময় খেয়াল রাখবেন নখগুলোও যাতে নেয়া হয় (খামাখা এটা ফেলে লাভ কি,কাষ্টমারই তো খাবে !)। নখগুলোর উপরের হাল্কা চামড়াও ছাড়ুন । এবার মুরগীর মাথা ,গলা,গিলা ,চামড়া এইসব মুরগী থেকে আলাদা করে নিন। এবার মৃদু আঁচে মুরগীর এই জিনিসগুলোকে ভাপিয়ে নিতে হবে । অযথা চুলার লাকরি খরচ করার দরকার নাই এজন্য । ভাত যখন রান্না করবেন তখন ভাতের উপর জিনিসগুলো দিয়ে দিন । ওতেই এগুলো আধাসিদ্ধ হবে । এবার আধাসিদ্ধ জিনিসগুলো আগেই তৈরি করে রাখা আলুর ঝোলটাতে দিন । ব্যস তৈরী হয়ে গেল মুরগীর লটপটি।

কেউ বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা এরকম রেসিপিরই একটা লটপটি আমাদের মনে হয় খেতে হয়েছিল আপ্যায়ন হোটেলে । খাওয়ার পর কেউ বলল বমি বমি লাগছে ,কেউ বলল সারা জিন্দেগীতে এর মত কুখাদ্য খায় নি । একটা বিষয়ে সবাই একমত হল যে আর যাই হোক না খেয়ে মারা যাবে সবাই তবুও ঐ রেস্টুরেন্টে আর খাবে না । দুপুরে খাওয়া হল ঐ হোটেলের পাশের হোটেলটায় । সেটাতে অবস্থা এত খারাপ না হলেও খুব একটা সুবিধার না । বাহিরে খাওয়া-দাওয়ার এত অসুবিধা বিধায় সিদ্ধান্ত হল আমরা যে হোটেলে উঠেছি ওখানেই খাই । ওখানে কয়েকবেলা খেতে-খেতে পকেটের এমন হাল হল যে ঢাকায় ফেরাই দুরূহ হয়ে পড়ল। ঐ হোটেলের মালিক নাকি জার্মানী থেকে ট্যুরিজমে পড়াশুনা করে এসেছেন । আসার সময় সাথে করে এনেছেন এক বাবুর্চি । নাস্তার বিল না অন্য কিছু !নাস্তার বিল না অন্য কিছু !মালিক মনে হয় বাবুর্চির বেতন পর্যটকদের খাইয়ে সেখান থেকে আদায় করার কথা ভেবেছেন । একজন খাওয়ার মত একবাটি ডাল বিশ টাকা , সবজী পঁচিশ টাকা । একটা পরাটা খাবেন সেটাও আট টাকা করে , চায়ের দাম দশ টাকা । সকালে ডিম-পরোটা-ডাল-চা নাস্তা করলেই বিল আসে সবাই মিলে পাঁচশ টাকার কাছাকাছি । আলুভর্তা-ডাল-ভাতের বিল সাড়ে চারশ পেরিয়ে যায় । মাছ-মাংসের কথা না হয় নাই বলি । ওগুলো হাজার টাকার নিচে পাওয়ার নয় । এই রকম বিল আর যাই হোক আমাদের মত বেকার ছাত্রদের খুব বেশীদিন দিতে পারার কথা নয় । হলও তাই । চার-পাঁচ বেলা খাওয়ার পর মনে হল এবার ক্ষান্ত হওয়া প্রয়োজন , না হলে সাথের জিনিসপত্র বিক্রি করে ঢাকায় ফিরতে হবে । অতপর অনেক খুঁজে-পেতে ,অনেকের কাছে শুনে একটা সস্তা এবং ভাল হোটেলের খোঁজ পাওয়া গেল । হোটেল আমতলী । এক বৃদ্ধ লোক হোটেলটার দেখাশুনা করেন , অপরিচিতদের "কাহা" বলে ডাকেন । কাহা কি খাবেন ?কাহা আর কিছু লাগব? এই হোটেলের খাবার বেশ ভাল এবং সস্তা । আগেরটার নাস্তার বিল দিয়ে এখানে দুপুর আর রাতের খাবার আমিষ সহযোগে খাওয়া যায় । আমরা থাকতেই বুয়েটের আরেকটা গ্রুপের দেখা হয় কুয়াকাটায় । ওদেরকেও আমরা এই হোটেলটিতে খেতে বলি । কুয়াকাটা থেকে ঢাকায় ফেরার সময় বরিশালে কয়েকঘন্টার জন্য যাত্রাবিরতি নিতে হয়েছিল । এখানে একটা খাবার হোটেল আছে "হোটেল নাজ গার্ডেন" । এখানকার মোরগ-পোলাও আর কাচ্চি বিরিয়ানীও বেশ ভাল ।

শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০০৮

কুয়াকাটা-০৩

[১]মিশ্রিপাড়ায় গেছি বৌদ্ধমন্দির দেখতে । এত বড় গৌতমের মূ্র্তি নাকি বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই । দেখলাম , বেশ বড়ই মূর্তিটা । এরপর মিশ্রিপাড়ায় রাখাইনদের পাড়ায় একটু হানা দিয়ে একটা স্কুলের সামনে এসে পড়লাম । প্রাথমিক বিদ্যালয় প্লাস হাইস্কুল দুটোই একসাথে । আমরা স্কুলের সামনে দাড়িয়ে স্কুলটা দেখছিলাম আর খোশগল্প করছিলাম । এমন সময় ক্লাসরুম থেকে একজন শিক্ষক বেড়িয়ে আসেন । হ্যালো,আই আম এন এসিসটেন্ট ইংলিশ টিচার অব দিস স্কুল । আমরা কুয়াকাটায় সাইপ্রাসিয়ান বাংঙালি ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে যেরকম অবাক হয়েছিলাম তার চেয়েও বেশী অবাক হয়ে পড়ি । ব্যাপার কি ? সবাই ইংলিশ কয় ক্যা? আমরা বলি ও , আচ্ছা । ভদ্রলোক এবার স্কুলের গুনগান গাইতে শুরু করেন। দিস স্কুল হ্যাজ এ গুড রেজাল্ট ইন এস,এস,সি এক্সামিনেশন । লাষ্ট ইয়ার এইট স্টুডেন্টস ফ্রম দিস স্কুল গট A+ অ্যান্ড টু অব দেম ওয়ার গোল্ডেন A+ । আমরা বলি ,ও আচ্ছা , বেশ ভাল রেজাল্ট তো । ভদ্রলোক এবার বলেন, ইউ ওয়ান্ট টু সী সামথিং মোর অব দিস স্কুল ? আমরা একটু ইতস্তত করি । না মানে ইয়ে ......। অবশেষে আমাদের মধ্যে একজনের আগ্রহে হ্যাঁ বলি । উনি আমাদের সাথে করে হাইস্কুলের একটা কামড়ায় নিয়ে যান । রুমে চার-পাঁচটি বেঞ্চ বসানো । এর মধ্যে সমকোনে রাখা দুটি বেঞ্চে বসে পাঁচ-ছয়জন ছাত্র পড়ালেখা করছে । ভদ্রলোক বলতে শুরু করেন । দিস স্টুডেন্টস উইল অ্যাপিয়ার ইন দ্যা জুনিয়র স্কলারশিপ এক্সামিনেশন দিস ইয়ার । আই অ্যাম ট্রাইয়িং টু টেক এক্সটা কেয়ার অব দেম এন্ড ট্রাইয়িং মাই লেভেল বেষ্ট । ইউ ক্যান টেষ্ট দিস স্টুডেন্টস । আমরা বলি , না , ঠিক আছে । কিন্তু ভদ্রলোক ক্ষাম্ত দেন না । প্রথম বাংলা শুনি এবার আমরা তার মুখে । এই ট্রান্সলেশন কর, আমি একজন ইন্জিনিয়ার হতে চাই ......। তিনি আবারো ইংরেজী শুরু করেন । ইউ ক্যান আস্ক দেম অ্যাবাউট দেয়ার এমবিশন অব দেয়ার লাইফ । আমাদের কথা বলার আগেই ছাত্রদের বলেন, টেল ইন ইংলিশ হোয়াট ইউ ওয়ান্ট টু বি ইন ইওর লাইফ । ছাত্ররা একজন একজন করে দাড়ায় আর বলে কে জীবনে কি হতে চায় । কেউ ডাক্টার হতে চায় , কেউ ইন্জিনিয়ার । ভদ্রলোক ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেন , দিস পিওপল আর ফ্রম বুয়েট এন্ড দে আর গোয়িং টো বি ইন্জিনিয়ার । ইফ ইউ ওয়ার্ক হার্ড ইউ ক্যান অলসো গো দেয়ার । ছাত্ররা মাথা নাড়ে । ইয়েস স্যার । আমাদের নিয়ে ভদ্রলোক বেড়িয়ে পড়েন । ইফ ইউ হ্যাভ টাইম ইউ ক্যান মিট আওয়ার হেডমাষ্টার । আমরা বলি , না ,ঠিক আছে , আজকে আর না । প্রাইমারী স্কুলটার মনে হয় টিফিন চলছিল । খোলা মাঠে অনেক ছাত্রছাত্রী খেলাধুলা করছিল । আমরা বলি , এসো তোমাদের সাথে ছবি তুলি । সবাই এরা ছবির জন্য দাড়িয়ে যায় । ডিজিটাল ক্যামেরার ক্লীক শুনেই সবাই দৌড়ে যায় অমরের কাছে । সেই ছবি তুলছিল । সবাই ছবি দেখতে চায় । সবাইকে ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখিয়ে মুক্তি পেতে হয় ।

[২]বাহিরে কোথাও বেড়াতে গেলে সবাই মিলে টাকা-পয়সা দিয়ে আমরা একটা ডেটাবেস তৈরী করে নেই । যাতায়াতের ভাড়া ,হোটেল ভাড়া ,খাওয়া খরচ এইসব এই ডেটাবসে থেকেই দেয়া হয় । আর প্রতিবার এই ডেটাবসের ম্যানেজারের কাজটা আমাকেই করতে হয় । এবারও ম্যানেজার ছিলাম কিন্তু এবার দু-একটা ছোটখাট ঘটনা ঘটে গেছে এবং এ থেকেই বুঝে গেছি বয়স বাড়ছে , বুড়ো হয়ে যাচ্ছি । এধরনের ভুল সাধারনত বুড়োদেরই হয় ।

ঘটনা-১ : ফাতরা বনে যাব । নদী আর সাগরের একটা মোহনা পাড় হতে হয় ট্রলার দিয়ে । ট্রলার ভাড়া ঠিক হল ৩৫০ টাকা । ফাতরা বনে গিয়ে ট্রলারওয়ালারা ৫০ টাকা চাইল , চা-নাস্তা খাবে । দিলাম । ফাতরা বন থেকে ফিরে এসে ৩০০ টাকা দিতে হবে । খুচরা টাকা নেই , সব পাঁচশো টাকার নোট । ট্রলারওয়ালা একটা দোকানে নিয়ে গেল । দোকানদার ২০০ টাকা দিল ৫০০ টাকার নোটটা নিয়ে । আমরা ভ্যানে চড়ে রওয়ানা হলাম কুয়াকাটার দিকে । মিনিট ত্রিশেক হওয়ার পর পিছনে কার জানি উচ্চস্বরে ডাক শুনে দুটা ভ্যানই থামানো হল । দেখি সাইকেল নিয়ে ট্রলারওয়ালা এসে হাজির । বুঝলাম ঝামেলা আছে । হয়ত যে পাঁচশ টাকার নোটটা দিয়েছিলাম সেটা জাল । মাইর আজকে একটাও বোধহয় মাটিতে পড়বে না। ট্রলারওয়ালা অনেক জোরে সাইকেল চালিয়ে এসেছে । সে এসেই হাঁপাতে শুরু করল , আপনাদের মধ্যে কে টাকা দিল তখন । একজনকে দেখিয়ে বলল আপনি না । সেই একজনও বোধহয় ভয় পেয়ে গেল । সে বলল না আমি না । আমি তখন আর সরাসরি ট্রলারওয়ালাকে বললাম না আমি দিয়েছি টাকা তার বদলে বললাম কেন কি হয়েছে ? সে বলল টাকা তো দেননি । আমি আকাশ থেকে পড়লাম । কেন পাঁচশ টাকার নোট যে দেওয়া হ , দিয়ে দুইশ টাকা নেওয়া হল । না টাকা দেননি , দেখেন । আমি মানিব্যাগ বের করে টাকাগুলা গুনলাম । না আসলেই টাকা দেয়া হয় নি । একটা পাঁচশ টাকার নোট বেশী দেখা যাচ্ছে । ট্রলারওয়ালার কাছে মাফ-টাফ চেয়ে নোটটা দেয়া হল।

ঘটনা-২ : প্রতিটা বীচেই বীচের পাশে মনে হয় শামুক-ঝিনুকের দোকান থাকে । এখানেও আছে । পোলাপান সবাই মিলে হল্লা করে নানান জিনিস কিনল সেখান থেকে । আমিও দুয়েকটা জিনিস কিনব বলে দোকানে গেলাম । কি কিনি ? কেনার মত কিছুই না পেয়ে তিনটা ঝিনুকের মালা কিনলাম । এই মালা দেওয়ার মত কেউ নাই ,এমনকি ছোটবোনও নাই যে দেব । তারপরেও কেনা । দোকানে টাকা পয়সা দিয়ে মালার প্যাকেটটাও মনে হল নিয়েছি কিন্তু ত্রিশ-চল্লিশ পা যাওয়ার পর মনে হল আসলে প্যাকেটটা আমার কাছে নাই । সামনে সবাই দাড়িয়ে ছিল । এদের বললাম ঐ তোরা আমার প্যাকেটটা নিছস নাকি?

-কিসের প্যাকেট?

-ঐতো কয়েকটা জিনিস কিনছিলাম ঝিনুকওয়ালদের দোকান থেকে । ঐ প্যাকেটটা কি তোদের কাউকে দিছি । তোরাও তো আশেপাশে ছিলি ।

-কি কিনছিলি ? অনেকের প্রশ্ন । খাজনার চেয়ে বাজনা বেশী হলে যা হয় আরকি।

-ঝিনুকের মালা কিনছিলাম কয়েকটা ।

-কারে দিবি ? এর আগেও কক্সবাজার থেকে যে মালাগুলি কিনছিলি তার খবর কি? কারে দিসছ ?

-কাউরে দেইনি । আছে , আমার কাছেই আছে । বউরে দিমু । এবারের গুলাও বউরে দিমু ।

-বউতো নাই ।

-আরে ব্যাটা আজকে বউ নাই বইলা যে কালকে হইব না তার কি গ্যারান্টি । এত প্যাঁচাইতেছোস ক্যা ? মালা কাউরে যদি দিয়া থাকি তো ক ।

সবাই একসাথে হেসে ওঠে ।

- আর হইছে বউ । এহন পর্যন্ত প্রেমই করতে পারলি না..................। না আমাদের মালা দিস নি । ঐ দোকানেই আবার যা খুঁইজা দেখ ।

আবার মালার দোকানটাতে যাই । দোকানদারকে বলি ভাই দেখেন তো আশেপাশে খুঁজে । মালার প্যাকটটা মনে হয় নেই নাই । এখানেই কোথাও ফেলে গেছি মনে হয় । দোকানদার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আশেপাশে খোঁজে । কোথায় আর থাকব , আপনে তো নিয়াই গেলেন । দোকানদার প্যাকেটটা আর খুঁজে পান না । দোকানদারের সাথে একজন লোক বসে ছিলেন । তিনিও বলেন তার নাকি স্পষ্ট মনে আছে আমি দোকান থেকে প্যাকেটটা নিয়ে বের হয়েছি । আমি মনে মনে বলি ভাই আমারওতো স্পষ্ট মনে আছে আমি প্যাকেটটা নিয়েই বের হৈছি । কৈ রাখলাম । পরীর আছর পড়ল নাকি ? প্যাকেটটা আর পাওয়া যায় না ।

নিজের খবর আর নিজে রাখতে পারছি না । বিশেষ কাউকে মনে হয় খুব দরকার !

সোমবার, ১০ নভেম্বর, ২০০৮

যাপিত জীবন-০৬ : : আপনার আরডস নাম্বার কত ?

<১> কয়েকদিন আগে গ্রাফ থিওরির ক্লাসে স্যার জিজ্ঞাসা করলেন তোমাদের কারও কি নিজের আরডস নাম্বার জানা আছে । আমরা আকাশ থেকে পড়লাম । কে এই আরডস ? আমাদের কাছে কি আদৌ তার কোন নাম্বার থাকার কথা ? থাকলে জানি না কেন ? মহাখাপ্পা বিষয় হয়ে যাচ্ছে না ! তবে স্যার যখন জিজ্ঞাসা করছেন তখন নিশ্চই আমাদের আছে ! আমরা সবাই আরডস নাম্বার থেকেও না জানার বিহবলতা থেকে তার দিকে তাকালাম । স্যার বলতে শুরু করলেন ।

আরডস সাহেব একজন হাঙ্গেরিয়ান গণিতবিদ । গণিতবিদ তো কি হয়েছে ? কেন তার নম্বর থাকবে ? আসলে আরডস সাহেব ছিলেন একজন অমানুষিক(!) গণিতবিদ । ওনার ১৫০০ খানা গণিত বিষয়ক রিসার্চ পেপার আছে । যারা রিসার্চ কাজে আছেন তারা জানেন এতখানা বিসার্চ পেপার থাকার মানে কি ! আরডস এই বিশাল কাজগুলো করেছেন ৫১১ জন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে । এই সাঙ্গপাঙদের আরডস নাম্বার ১ আর আরডস সাহেবের নিজের আরডস নাম্বার ০ । আরডস নাম্বার ২,৩ এগুলো তাহলে কাদের । আরডস নাম্বার ২ হল তাদের যারা আরডসের সাঙ্গপাঙদের সাথে অন্তত একখানা পেপার বের করতে পেরেছেন যদিও এরা সরাসরি আরডসের সাথে কোন কাজ করেন নি । এভাবে আরডস নাম্বার ৩ কাদের সেটা এখন নিশ্চয় বুঝতেই পারছেন।

স্যার এটা বলার পর আমরা বুঝে গেলাম যে আমাদের আরডস নাম্বার ১ হওয়ার কোন কারন নেই কারন আরডস সাহেবের সাথে কাজ কোনদিন করেছি বলে মনে পড়ে না ! আরডস নাম্বার ২,৩,৪ কিছু একটা হওয়ার কারন থাকতে পারে কিন্তু সেটা নির্ভর করছে স্যারের উপর । অনেকেই তো ওনার আন্ডারে থিসিস করছি । যা-তা করে খেটেখুটে স্যারের সাথে একটা পেপার বের করলেই হল । ব্যস আরডস নাম্বার আর ঠেকায় কে ? স্যারের আরডস নাম্বারের সাথে ১ যোগ করলেই হবে । আমরা আরডস নাম্বার প্রাপ্তির আশায় স্যারের মুখের দিকে তাকালাম । স্যার বললেন তার আরডস নাম্বার ৩ হতে পারে । মুখটা চকচক করে উঠল আমাদের । ৪ আরডস নাম্বার প্রাপ্তি তাহলে সময়ের ব্যাপার মাত্র ? যাক না আর কয়েকটা দিন ।



<২> আরডস সাহেবের কিছু মহান উক্তি -

১। শিশুরা হল এবসাইলন (গণিতে ক্ষুদ্র ধনাত্বক মান সূচিত করতে এবসাইলন ব্যবহৃত হয়) ।
২। নারীরা হল বস(Boss) , নররা কৃতদাস (!)।
৩। যে গণিত করা বন্ধ করেছে সে মৃত ।
৪। বিবাহিত পুরুষ বন্দী ,অবিবাহিত পুরুষ মুক্ত ।
৫। সঙ্গীত মানে হল গোলমাল , কলরব , অহেতুক শব্দ ।

শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০০৮

যাপিতজীবন -০৫: : গাঁজাখুরি

ঢাকা শহরে থাইকা চোখ আর কানের ব্যায়াম বেশি হয় , চোখ আর কানের ব্যায়াম কম হওয়া দরকার , মামুন কয় । আমি কই, হ ,উচিত কথা , চোখ আর কান কি হাত-পায়ের পেশী , ব্যায়াম কইরা ফুইলা তোলন লাগব ,এদের দুইটার ব্যায়াম যত কম হয় তত ভাল । সে কয় , চোখের ব্যায়াম কম করন খুব কঠিন , চোখ হালায় এমুন ফাউল খালি ব্যায়াম কইরতে চায় , অনেক কষ্ট কইরা রাত্রে চোখ বন্ধ করন লাগে , দিনে রাস্তায় রুজ পাউডার মাখা মাইয়াগো দিকে চাইয়া রয় , কারও কথা শোনে না , এরে ব্যায়াম কম কইরতে কবা ক্যামনে ? আমি কই , হ , কানের ব্যায়ামও কিন্তু কম হয়না সারাদিনে , ইচ্ছা নাহইলেও এইটা ব্যায়াম করে । সকালে কাঊয়ার ডাকে এর ব্যায়াম শুরু , সারাদিন ক্লাসমেট-বন্ধুবান্ধবের , ক্লাসে স্যারের বগরবগর , রাত্রে কি শান্তি আছে ? চট্রগ্রাম থাইকা পাইকারী মাল নিয়া চানখারপুলমুখী অথবা চানখারপুল থাইকা মাল খালী কইরা চট্রগ্রাম অভিমুখী ট্রাকের ঘোঁঘোঁ শব্দে ঘুমের মইধ্যেও কানের ব্যায়াম হয় , আমি তো কই কানের ব্যায়ামই চোখের চাইতে বেশী ।সে কয় , ঠিক কইছ , এই দুইটার ব্যায়াম কিছুদিন বন্ধ করন দরকার । আমি কই , ঠিক কইছ । সেও আবার আমারে কয় , হ ঠিক কইছ । এভাবে আমরা দুইজনে ঠিক কইছ কইতে থাকি যদ্দিন না দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট থানার করতোয়া নদীর পাশের নদীর অববাহিকা অথবা নদীর চরে যাই , গিয়া কান আর চোখ ঠান্ডা কইরা নিয়া আসি ।

নদীর চর তো নয় যেন একটা বাগান , সে কয় । কানের ব্যায়াম কমাইতে আসছি , এত কথা কিসির ? আমি দেখি , মামুনের বাগান দেখি । এইটা ভুট্রার বাগান অথবা বাঁধাকপি-ফুলকপির বাগান অথবা সরিষার বাগান হইতে পারে অথবা ভুট্টা-বাঁধাকপি-ফুলকপি ও সরিষার সম্মিলিত বাগানও হইতে পারে । সে কয় , বহুত দিন পরে এইরম দেখলাম , সরিষা , গোটা মাঠটা কেমন হলুদ হইয়া আছে , দেখছ । আমি সরিষার মাঠের হলুদ দেখি । সে কয় , দেখছ মিয়া ঐখানে ভুট্টা গাছগুলা দেখছ , মাসখানেকের গাছ হইব বোধহয় , দূর থাইকা কেমন ঘাসের মতন দেখা যায় , দেখছ । আমি দূরের , আরো দূরের চরে অথবা নদীর অববাহিকায় ঘাসের মতন ভুট্টা অথবা ভুট্টার মত ঘাসদের দেখি । সে কয় ,চেন নাকি ,পাশের ক্ষেতের এইগুলারে চেন । আমি কই , চিনি চিনি , ফুলকপি । সে কয় ধুর মিয়া , এইগুলান বাঁধাকপি ,খিয়াল কইরা দেখ । আমি খিয়াল কইরা দেখি ,ফুলকপি অথবা বাঁধাকপির গাছ দেখি । ফুলকপি অথবা বাধকপি , ঘাস অথবা ভুট্টাগাছ , হলুদ সরিষা ক্ষেত দেখতে আমার ভাল লাগে । তারা আমারে চোখের ব্যায়াম কমাইতে দেয়না । অনেকদিন পর চোখের ব্যায়াম কইরা আমার আরাম হয় । চোখের ভাল ব্যায়াম হওয়ার পরে আমার ঠোটের ব্যায়ামের দরকার হইয়া পড়ে। আমি একটা বেনসন ধরাই । মামুন ঠোটের ব্যায়াম করে না । তাই সে মুখের ব্যায়াম শুরু করে । সে আম্রিকা নামের একটা দেশে যাইতে চায় । সে কয় , আমেরিকা গেলে চোখ নষ্ট হইতে পারে , ঐ দেশে চোখের ব্যায়াম বেশি হয় , বাস্তায় নামলে চোখ এদিক সেদিক যায় , উপরে নিচে যাইতে চায় ধইরা রাখা যায় না ,আমরা আমেরিকা গেলে চোখের ব্যায়াম কম কইরা করবনে । আমি কই , হবেনে । সে এতদিনেও বোঝেনি শহরে চোখের ব্যায়াম কইরতে আমার খারাপ লাগে না , আসসোস । সে কয় , অই মিয়া জিআরইটা তুমি দিয়া ফালাও আমি দিচ্ছি জিম্যাটটা , আমেরিকা যাইতেই হইব বুঝলা । আমি সিগারেট খাই , বেনসন না অইন্য কিছু , টেষ্ট বইলতে কিছু নাই , ড্যাম হয়া গেছে মনে হয় , ছুইড়া ফেলি , ঠোটের ব্যায়াম ভাল হয় না । এরপর সে ভাবে , অনেকক্ষন ধইরা কি জানি ভাবে ,এরপর কয় , শালা , চুর্দিভাই দেশ একটা আমেরিকা ,একবার যাই , এরে ভাল মত ব্যায়াম করাইতে হইব।






সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০০৮

বোয়াল

আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমি একবার মাছ ধরতে যাই । এটাকে অবশ্য মাছ ধরা না বলে মাছ দেখাও বলা যেতে পারে । আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল জ্যোসনা রাতে করতোয়ার বোয়ালরা তীরের খুব কাছাকাছি চলে আসে । পানিতে তাকালে নাকি বোয়ালের জ্বলজ্বল করা রূপালী চোখ দেখা যায় । রূপালী চোখ নিয়ে বোয়ালরা যখন চারপাশে ঘুরে বেড়ায় তখন যে দৃশ্যের সৃষ্টি হয় তার নাকি কোন তুলনা নাই । তাই বোয়ালের এই চোখ দেখার উদ্দেশ্য নিয়েই আগষ্ট মাসের হাল্কা গরমের এক রাতে করতোয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম ।

নজুপুর হাটের পাশেই এই করতোয়া নদী । হাটসংলগ্ন নদীর তীরটা ক্রমশ ভাঙছে । দোকানীদের হয়েছে অসুবিধা। কিছুদিন পরপরই দোকান সামনে এগিয়ে নিতে হয় , নদী এগিয়ে আসে । করতোয়ার অপর তীরে দীর্ঘ চর । চরের বালিতে আখ , চীনাবাদাম আর আলুর চাষ হয় । চর থেকে ওপারের গ্রাম্য হাটটা দেখতে ভালই লাগে । হাটের রাতে তীরসংলগ্ন দোকানগুলোর হ্যাজাক আর কুপির আলো দোকানের ফাঁকা ফাঁকা করে বসানো কাঠের চিরগুলোর মধ্য দিয়ে নদীতে এসে পড়ে । মনে হয় অজস্র জোনাকী যেন সার বেঁধে নদীর পানিতে এসে লম্বা লাইন দিয়েছে । আজও হাটবার ছিল । দেখতে দেখতে হাটটা ফাঁকা হয়ে গেল সন্ধ্যার পরপরই । গ্রামের হাট,বেশী রাত জাগার অভ্যাস নেই ।। হাট থেকে ফিরে আসা শেষ নৌকার লোকগুলোও চরের মধ্যে কিছুক্ষন বসে বিড়ি-সিগারেট খেয়ে ফিরে গেল । এই বিস্তীর্ণ চরে মানুষ বলতে গেলে এখন বোধহয় শুধু আমি আর রজব সরদার।

রজব সরদারের বয়স প্রায় পয়তাল্লিশের কাছাকাছি । খাটো ,পাতলা টিঙটিঙে একজন লোক । এ বয়সে মাথার চুল কিছু পাকার কথা থাকলেও এনার চুল পাকে নি । রজবের বাড়ী এই করতোয়ার পাশেই কেবলাপুর গ্রামে । ঘরে জোয়ান ছেলেরা আছে । তারাই জমিজমা দেখাশুনা আর ক্ষেতখামারীর যাবতীয় কাজ করে । রজব সরদার মাছ ধরেন । মাছ ধরা তার পেশা নয় নেশা । যদিও রজবের কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায় কাজটা নিতান্তই শখের বশে হলেও বেশ মনযোগ দিয়েই পেশাদারিত্বের সাথে করেন তিনি । রজবের সাথে আমার প্রথম যখন এই অঞ্চলে এসে দেখা হয় তখন সে আমাকে বলেছিল ,
‘ বুঝলেন মাছ ধরাটা হইল গিয়া একটা বদ নিশা , মদ আর মাইয়া মানুষের চাইয়াও খারাপ নিশা , সহজে ছাড়ান যায় না । যৈবনে যে একবার মাছ ধরে বুড়া বয়সে আইসাও তারে মাছ ধরতে হয় ।‘
আমি রজবের কথা শুনে সেসময়ে হেসেছিলাম ।

অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের রাত । সারাদিনে গরম থাকলেও রাতের বেলা দেখি চরে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব । উত্তরবঙ্গ, এখানে শীত বেশ তাড়াতাড়িই আসে । রজব আমাকে ফুলহাতা শার্টটার নিচে গেন্জিজাতীয় কিছু একটা পরে নিতে বলেন । আমি বলি ,
‘কোন গেন্জি তো আনি নি’ ।
রাতে এরকম শীত পড়বে কে জানত ? রজব বলেন,
‘ চিন্তা কইরেন না । চালা থেকে গিলাপ(চাদর) দিয়া দিমুনে।‘

এই চরের মধ্যে রজবের চালা আছে জেনে আমি একটু আশ্চর্য হই । আরও আশ্চর্য হই চালার গঠনশৈলী দেখে । চালা ঘর বলতে যে রকম ঘর কল্পনায় চলে আসে সেরকম ঘর এটা নয় । কোন রকমে দুইজন মানুষ থাকার জন্য একটা কুঠুরিমতন জিনিস তৈরী করা হয়েছে আখের পাতা আর বাশের কঞ্চি দিয়ে । কয়েকটি কঞ্চি এক জায়গায় করে খুঁটির মত বানিয়ে উপরে আখের সরু পাতা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে । প্রথম দিন যখন রজবের সাথে এই চরে দেখা হয়েছিল তখন চালাটি চোখে পড়ে নি । আমি রজবকে বলি ,
’ কি এখানে থাকেন নাকি ?’
রজব বলেন ,
’ মাছ ধরন হইল গিয়া ধৈর্য্যের কাম । কতক্ষন আর ধৈর্য্য রাখা যায় । মাঝে মইদ্যে চালায় যাই , খানিকটা জিরায়া আসি। বাড়ী থাইকা আহনের সময় সাথে মশারী নিয়া আহি । মশার যন্ত্রনা আছে । চারপাশে টাঙায়া দেই । ইচ্ছে হইলে তাই ঘুমোনও যায় ।‘
রজব আমাকে চালার মধ্য থেকে চাদর বের করে দেন । চালার মধ্যে রজবের মাছ ধরার সামগ্রী আর কিছু শুকনা খাবারও দেখি । আমার আর তর সয় না , বলি ,
’ চলেন , মাছ ধরার আয়োজন শুরু করি ।‘

যদিও আমার উদ্দেশ্য মাছ ধরা নয় মাছ দেখা তারপরও রজবকে মাছ ধরার কথাই বলতে হয় । এই নিশুতি রাতে কেউ একজন মাছের চোখ দেখার জন্য এই চরে পড়ে আছে এটা শুনলে রজব নিশ্চয় আমাকে পাগল ভাববে । রজব অনিকক্ষন কাশেন । চরের ঠান্ডা হাওয়ায় দিনের পর দিন থেকে হয়ত কাশি লাগিয়ে ফেলেছেন । কাশি থামানোর পর বলেন ,
‘ চ্যাং দিলেও এহন কাম হইব না । মাছেরা মানুষের চাইতে রাত ভাল বোঝে , বেশী রাত না হইলে তীরের কাছে আহে না ।‘
চ্যাং শব্দটা আগে কোনদিন শুনেছি বলে আমি মনে করতে পারি না । রজবের কাছে জানতে চাই এই চ্যাংটা কি ? রজব বলেন ,
‘ চ্যাং হইল গিয়া গড়াই মাছেরই একটা জাত । তয় এরা বেশী অস্থির । বরশীতে গাঁইথা পানিতে ছাইড়া দিলে খালি লাফায় । এদের বোয়াল কামুড় দিলেই বোয়াল শ্যাষ , বরশী ঢুইকা যায় বোয়ালের মুখের মইদ্যে ।‘
রজব চালাঘর থেকে চটের একটা বস্তা এনে চরের হাল্কা ভেজা বালিতে পেড়ে দেন । আমি বসি । রজব হুকায় টান দিতে থাকেন । এই দিনেও লোকজন হুকা খায় এটা আমার জানা ছিল না । আমি তন্ময় হয়ে রজবের হুকা খাওয়া দেখি । রজব গল্প জুড়ে দেন , নিতান্ত পারিবারিক গল্প ।

রাত গভীর হয়ে গেল রজব পলিথিনের একটা প্যাকেট থেকে চ্যাং বের করা শুরু করেন । প্যাকেটের পানিতে দেখি এরা ভালভাবেই বেঁচে আছে । রজবের কথাই ঠিক , এই মাছ অতিশয় অস্থির । হাতে নেয়ার সাথে সাথে মাথা ও লেজ একসাথে প্রবলবেগে নাড়াতে শুরু করে । রজব একটা একটা করে চ্যাং বরশীতে গাঁথেন । শরীরের মাঝামাঝি বরশী গাঁথার ফলে চ্যাং আরও বেশী করে লাফাতে শুরু করে । বরশীর সূতাটার আরেক মাথা বাঁধা হয় শক্ত বাশের কঞ্চির সাথে , নদীর পাড়গুলোতে এগুলো নাকি পোতা হবে । আমি আর রজব দুজনে মিলে সবগুলো কঞ্চিগুলো কিছুদূর ফাঁক ফাঁক করে করে তীরে গেড়ে আসি ।

আমরা চালার সামনে এসে বসে পড়ি । রজব আবার বলতে শুরু করেন ,
‘ বুঝলেন তো মাছ ধরা হইল গিয়া ধৈর্য্যের কাম....... ।‘
হ্যাঁ , মাছ ধরা যে আসলেই চরম ধৈর্য্যের একটা কাজ সেই রাতে সেটা বুঝতে পারলাম হাড়ে হাড়ে । অনেকক্ষন আগে চ্যাংসমেত বরশী দেয়া হলেও সেগুলোতে কোন মাছ পড়ে না । আমি মাঝে মাঝে পানির কাছাকাছি গিয়ে টর্চ মেরে দেখি , বোয়ালের চোখ খুঁজি । রজব হয়ত মনে করেন মাছ পড়ছে না দেখে আমি অস্থির হয়ে পড়েছি । আমাকে বলেন ,
‘ ঘুরনের কাম নাই আপনের , এইহানে আইসা বসেন । বোয়াল পড়লে এমনিতে বুঝবেন , পানির মইদ্যে চ্যাংয়ের ছঠফটানি যাইব বাইড়া । বোয়াল আইসা চ্যাংরে একেকটা কামড়াইব আর চ্যাংও এদিক-ওদিক লাফাইব ।‘
হ্যাঁ , চ্যাংকে ঘায়েল করতে বোয়ালের বোধহয় ভালই সময় লাগে কারন পানিতে একসময় বেশ হুটোপুটির শব্দ শোনা যায় । নিস্তব্ধ করতোয়ার পাড়ে শব্দটা ঠিক যেন বর্শার ফলার মতই বেঁধে কানে । রজব বলেন ,
‘ চলেন একটা বুঝি পড়ল ।‘ আমি আর রজব তড়িঘড়ি করে যাই শব্দটার উৎসের কাছে ।

গিয়ে দেখি কঞ্চিটা ঠিকই চরের বালিতে গাড়া আছে , বরশীও ঠিক আছে কিন্তু বরশীতে গাঁথা মাছটা আর নেই । আমি রজবকে আমার বামে একটু দূরে পানিতে রূপালী রংয়ের একটা চোখ দেখাই ।
রজব বলেন , ‘ ওঠেন , তাড়াতাড়ি টর্চটা ফেলেন ঐদিকে ।‘
আমি আমার সাথে থাকা এক ব্যাটারীর টর্চের আলো নদীর পানিতে ফেলি । পানির মধ্যে রূপালী চোখ নিয়ে একটা বোয়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে ।
রজব অনেকক্ষন কেশে নেন তারপর বলেন , ‘এই বোয়ালটা অনেক বড় , গতবার পাইছিলাম এইরকম একটা। সচরাচর এইরকম বড় বোয়াল পাওয়া যায় না ।‘
আমি বলি ,’ কোথায় আমার কাছে তো খুব একটা বড় মনে হল না ।‘
রজব বলেন,’ আপনারা সাহেব-সুবা শহরের মানুষ , পানির উপরে থাইকা কি আর বোয়ালরে বুঝতে পারবেন।‘ এতবড় একটা বোয়াল হাতছাড়া হওয়ায় রজবের মন একটু খারাপই হওয়ার কথা কিন্তু তাকে দেখে সেরকম মনে হল না ।
তিনি বলে চললেন ,‘বুঝলেন যত বড় মাছ তত চালাক । চালাক না হইলে কি আর পানির এত শত্রুর মইদ্যে বাইড়া ওঠন সম্ভব । দেখলেন না চ্যাংটারে কেমনে খাইয়া গেছে । বরশী তো আমরা দিছিলাম চ্যাংয়ের পেটের মইদ্যে । এইটা কামুড় দিছে ল্যাজে । যাই হোক একবার যহন খাইছে তখন এইটা এহানেই থাকব । আসেন আমরা আরেকটা চ্যাং দেই ।‘
রজব আগের মতই পলিথিনের প্যাকেটটা থেকে আরেকটা চ্যাং এনে বরশীতে গেঁথে দেন । আমরা চালার সামনে গিয়ে আবার বসে পড়ি ।

খানিকক্ষণ পর আবার হুটোপুটির শব্দ শুরু হয় পানিতে । আগের জায়গাটা থেকেই শব্দটা আসছে । আমরা আবার প্রবল আগ্রহ নিয়ে কঞ্চিটার কাছে যাই ও হতাশ হই । চ্যাংটা নেই । হয়ত আগের বোয়ালটাই মাছটা খেয়ে গেছে অথবা নতুন কোন বোয়াল এসেছিল ।
রজব আমাকে বলেন , ‘ বুঝলেন আগের বোয়ালটাই চ্যাং টা খাইয়া গ্যাছে । এত জলদি জলদি আরেকটা পড়নের কথা না ।‘
রজব আরেকটা মাছ বরশীতে গেঁথে দেন এবং আগের মতই আমরা আবার চালার সামনে এসে বসি । আবার কিছুক্ষণ পর বরশীতে বোয়াল পাওয়ার শব্দ পাই কিন্তু কোন বোয়াল আর পাওয়া যায় না । রজবের এই একটা বরশীতেই আরো দুটা চ্যাং নষ্ট হয় , একটাতেও পড়ে না বোয়াল । রজব বিড়বিড় করে কি যেন বলেন । হয়ত মেজাজ খারাপ হয়েছে তার । আমার বেশ মজাই লাগে । আগেই বলেছি মাছ ধরার কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এই রাতে করোতোয়ার পাড়ে আমি আসি নি এসেছি জ্যোসনা রাতে বোয়ালের রূপালী চোখ দেখতে । সে আশা আমার প্রথমবারেই পূর্ণ হয়েছে । সে এক দৃশ্য বটে ! বন্ধুটা আমার ঠিকই বলেছিল । গোটা দুনিয়ায় এরকম সুন্দর দৃশ্য খুব একটা নেই ।

রজব বলেন ,’ বুঝলেন তো এইভাবে হইব না , পঁচা লাগব ।‘
রজব লোকটার এই এক মুদ্রাদোষ কথায় কথায় বলেন বুঝলেন । পঁচা জিনিসটা কি আমার মাথায় ঢোকে না । আমি বলি ,’ পঁচা কি’ ?
রজব বলেন , ‘ পঁচাই হইল আসল ধৈর্য্যের খেলা । আসেন আপনেরে দেখাই ।‘
রজব চালাঘর থেকে আরেকটা প্লাষ্টিকের প্যাকেট খোলেন । প্যাকেটের ভিতরে বেশ কটু গন্ধযুক্ত রোদে শুকানো পুঁটি মাছ । মাছগুলোর ভিতরের পুরো কাঁটাই বেশ দক্ষতার সাথে তুলে ফেলা হয়েছে । রজব একটা মাছ নিয়ে কাঁটার ফাঁকা জায়গাটায় একটা বরশী বিঁধে দেন । যে জায়গাটায় বোয়ালটা বারবার চ্যাং মাছগুলো খেয়ে যাচ্ছিল তার পাশেই নদীর পানিতে সামান্য দূরে বরশীটা ছুড়ে দিয়ে চরের মাটিতে বসে পড়েন ।
আমাকে বলেন , ‘ বসেন । এইবার হইল গিয়া আসল খেলা । পঁচাটা দিলাম পানির মইদ্যে , এহন বইসা থাকনের পালা । ফকফকা জোসনারা রাইত , খালি বইসা থাকবেন আর খিয়াল করবেন বরশীটার দিকে । পঁচার পুঁটিটা যখন বোয়ালে খাইব তখন বরশীর সূতাটা সইরা যাইতে থাকব একদিকে । বাস , যেইদিকে সূতাটা সইরা যাইব তার উল্টাদিকে দিবেন জোরসে একটা টান । বোয়ালের গলায় আটকাইয়া যাইব কাঁটাটা ।‘

রজবের কথায় আমি আশ্চর্য না হয়ে পারি না । এত মনযোগ দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কিভাবে পঁচার দিকে তাকিয়ে থাকা সম্ভব?
রজব আবার বলেন , ‘ এইজন্যি তো আপনেরে বারেবারে কই বড়ই ধৈর্য্যের কাম এইটা । এইযে বসছেন একবার পঁচা দিয়া , সারারাত বইসা থাকলেও যে মাছের নাগাল পাবেন তার কি কোন ঠিক আছে ?’

রজব বসে থাকেন । বসে থাকতে থাকতে পা লেগে গেলে একসময় আমাকে পঁচাটা দেন ।
‘ ধরেন , এট্টু তামুক খাইয়া আহি ।‘
আমি পঁচাটা ধরে বসে থাকি আর মাছের চোখ দেখার জন্য এদিক-ওদিক তাকাই । কিছুক্ষণ পরেই রজব আবার ফিরে এসে আবার পঁচাটা ধরেন । আমি নদীর ধারে এদিক-ওদিক হাটি , সিগারেট খাই , চালাঘরে শুয়ে থাকি । মাছ আর পঁচায় পড়ে না । দু-একবার রজবের কাছে যাই এখানেও নাকি বোয়াল টোপ খেয়ে যাচ্ছে ।
রজব বলেন , ‘ বুঝলেন বড়ই কাউটা মাছরে ভাই এইটা , ক্যামনে ক্যামনে জানি পঁচা খাইয়া যাইতাছে ।‘
আমি বলি,’ কিভাবে বুঝলেন এটা আগের বোয়ালটাই , অন্য বোয়ালও তো হতে পারে ।‘
রজব খানিকটা ক্ষেপে যান ।
‘ বিশ বছর ধইরা মাছ ধরতেছি । মাছেরে ভালই চিনি । তয় এরে ছাড়তেছি না আজকে । আপনে যান চালায় শুইয়া পড়েন ।‘

আমি চালাঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি । মশারীর ফাঁক দিয়ে চরের হাল্কা ঠান্ডা বাতাস ভেঙে ভেঙে ঘরটার মধ্যে ঢুকে পড়ছে। ঘুমানোর জন্য আদর্শ আবহাওয়া । ঘুমানোর ইচ্ছা না থাকলেও তাই একসময় ঘুমিয়েই পড়ি ।

ঘুম ভাঙে প্রায় শেষ রাতের দিকে , রজবের গজগজানিতে ।
‘ বুঝলেন এতদিন ধইরা মাছ ধরি এইরকম চালাক মাছ আর দেখিনি । চ্যাং-পঁচা কিছুই মানতেছে না । চলেন এইবার শেষ চেষ্টাটা করি , কাটাটা মারি ।‘
চালাঘরে আমি যেখানে শুয়েছিলাম তার নিচ থেকে পাতলা লোহার তৈরী শাবল জাতীয় একটা জিনিস বের করেন রজব । জিনিসটার মাথায় শাবলের মতই তীক্ষ্ণ ফলা । এটাই নাকি কাটা । রজব পলিথিনের ব্যাগ থেকে শেষ চ্যাংটা বের করেন । আগের মতই চ্যাং টা বরশীতে গেঁথে বরশীর সূতা কঞ্চিতে বেঁধে আগের জায়গাটাতেই পুতে ফেলেন ।
রজব বলেন , ‘ বুঝলেন শ্যাষবারের খেলা এইবার । বোয়ালের চ্যাং টারে ধরার আওয়াজ পাইলেই টর্চ মারবেন ঐ জায়গায় । এরপরে আমি আছি ।‘

আমরা আবার চরের মাটিতে বসে জলের শব্দ শুনতে থাকি । অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও যখন কোন বোয়াল আসে না তখন আমার মেজাজ সত্যিই খারাপ হতে থাকে , মাছ ধরাতো আমার কাজ নয় !
আমি রজবকে বলি,’ চলেন আজকে আর মনে হয় হবে না । ঐ বোয়ালটাই যে আসবে তার কি গ্যারান্টি ?’
রজব আমার কথার কোন জবাব দেন না । মনে হয় বিরক্ত হয়েছেন আমার ওপর । তবে মাছটার উপর তার ক্ষোভ কোন পর্যায়ে এসে পড়েছে তা বুঝতে পারি । আমি এবার রজবের সামনেই একটা সিগারেট ধরিয়ে বসে পড়ি । রজব বলেন ,’ সারারাইত তো থাকলেনই , এই শ্যাষবার একটু দেহেন ।‘

রজবের কথা মিথ্যা হয় নি । ফজরের আজানের ঠিক একটু আগে পানিতে চ্যাংয়ের লাফালাফি প্রবল হয়ে ওঠে । বোয়ালের রূপালী চোখটা আবার আমি দেখতে পাই । রজব মুখে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বলেন আর ইশারায় আলো ফেলতে বলেন । আমি পানিতে মাছটার উপর আলো ফেলি । আলো ফেলামাত্র রজব কাটাটা নিয়ে বিদুৎবেগে মাছটার শরীরে বিদ্ধ করার জন্য পানিতে লাফ দেন । বয়স্ক একজন লোক কিভাবে এত তাড়াতাড়ি কাটাটা সমেত পানিতে লাফিয়ে পড়ে কাটাটা মাছের গায়ে বিদ্ধ করার চেষ্টা করেন তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন । হয়ত টর্চের আলোয় মাছ দূরে সরে যেতে চায় । এত তাড়াতাড়ি না করলে চলবে কিভাবে ? রজবের শেষ চেষ্টাটা বিফলে যায় নি । বেশ বড় সাইজের কাটাবিদ্ধ একটা বোয়াল নিয়ে রজব উঠে আসেন পানি থেকে । কাটাটা দেখি বোয়ালের শরীরের ঠিক মাছখানে বিঁধেছে । থেতলে গেছে বেশ খানিকটা অংশ । রজবের মুখে বিজয়ীর হাসি ।
‘ কইছিলাম না আগের বোয়ালটাই , দেখছেন কত্ত বড় । আগের বছরে যেইটা পাইছিলাম তার চাইতে এটা বড় । বুঝলেন এইজন্যি কাটা দিয়া মাছ ধরি না , মাছের শইল বলতে কিছু থাকে না ।‘
আমি মাছটার দিকে তাকিয়ে থাকি । জলের মধ্যে জীবন্ত মাছের চোখ আর জলের বাহিরে মৃত মাছের চোখের মধ্যে কত পার্থক্য ।
রজব বলেন,’ আপনেরে কিন্তু আজকে আর সহজে ছাড়তেছি না । সকালে বাড়িত থাইকা মাছের পেটি দিয়া ভাত খাইয়া যাবেন ।‘

আমি কিছু বলি না । এরকম লড়াকু , পরাজিত আর অবশেষে মৃত বোয়ালটা দেখতে আমার কেন জানি ভাল লাগে না ।

শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০০৮

আংটি কাহিনী

বাবা-মা ধরনের মানুষগুলো যে খুব একটা কথা রাখে না এটা বুঝতে জাবেরের খুব বেশী দিন সময় লাগে নি । এই যেমন ক্লাস সেভেনে দুইবার একই ক্লাসে থাকার বিষয়টা । অনেকেই সরকারী বৃত্তি পাওয়ার জন্য পন্চম শ্রেনীতে দুইবছর থাকে । তাকে কেন এটা সপ্তম শ্রেনীতে এসে করতে হবে তা প্রথমদিকে তার মাথাতেই ঢোকেনি । বাবাকে জাবের বরাবরই ভয় পায় । নিরূপায় হয়ে মাকেই জিজ্ঞাসা করেছিল ব্যাপারটা । মা বলেছিলেন তার বয়স নাকি কম । অল্প বয়সে স্কুলে দেয়া হয়েছে । আর একটা বছর এই ক্লাসে থাকুক কিছুটা বয়সের পরিপূর্ণতা আসবে । জাবের শুরুতে কিছুটা গাইগুই করেছিল যদিও সে জানত তাকে এই ক্লাসে আরেকবার থাকতেই হবে কারন বাবার সিদ্ধান্তের বাহিরে বাড়িতে কোন কাজ হয় না । জাবের তাই একই বই আরেকবার পড়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল । মা হয়ত জাবেরের গাইগুই করার ব্যাপারটা বাবার কানে তুলেছিলেন । বাবা তাই একদিন জাবেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন জাবের যে এই ব্যাপারটা খুব সহজেই মেনে নিয়েছে এতে তিনি খুব খুশি হয়েছেন এবং জাবেরকে কিছু একটা উপহার দিতে চান সে উপহার হিসেবে কি পেতে চায় । জাবেরের ঐ বয়সে আসলে একজোড়া চাকাওয়ালা জুতা ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার ছিল না । এই চাকাওয়ালা জুতার নামই বা কি তা সে জানত না ।পাশের বাসার কলেজ পড়ুয়া এনাম ভাইকে সে দেখেছে কলোনির পীচঢালা রাস্তায় চাকাওয়ালা একজোড়া জুতা পড়ে সাইকেলের মত জোরে বিকেলে ঘুরে বেড়ায় । তারও এরকম একজোড়া চাকাওয়ালা জুতার খুব শখ , এনাম ভাইয়ের সাথে সে ও ঘুরে বেড়াবে , চক্কর দেবে পুরে কলোনী । বাবা শুনলে রেগে যাবেন এই ভয়ে সে কখনো কথাটা বলে নি । আজ যখন একটা সুযোগ এসেছে তখন সে বাবার কাছে এটার কথাই একবার বলে দেখল । বাবা মাথাও নেড়েছিলেন , দেবেন । জাবেরের এরকম একজোড়া জুতা পাওয়া হয়নি । তার বদলে সে যা পেয়েছে তা সে কখনোই মনে মনে আশা করে নি , একটা বিশ্রী চারকোনা জাপানি কেসিও ঘড়ি । উপহার হিসেবে ঘড়ি দেওয়ার কি আছে ? বাসার ড্রইং রুমেই তো একটা ঢাউস সাইজের দেয়াল ঘড়ি টাঙানো আছে । সময় দেখার জন্য হাতঘড়ির কি দরকার ? দেয়াল ঘড়ি থেকে দেখে নিলেই তো সে পারে । বাবা বলেছিলেন চাকাওয়ালা জুতোগুলোয় চলা নাকি খুব কঠিন , শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে । বললেই হল । জাবেরের খুব মন খারাপ হয়েছিল ।

অষ্টম শ্রেনীতে তাই বাবা যখন বললেন বৃত্তি পেলে একটা সাইকেল কিনে দেবেন জাবের তখন কথাটায় খুব একটা বিশ্বাস রাখতে পারে নি । তবুও তার মনে যে একটা ক্ষীণ আশা ছিল না তা নয় । ছাত্র হিসেবে সে খুব একটা খারাপ না হলেও অন্তত জেলা শহর থেকে বৃত্তি পাওয়ার মত একজন নয় । বৃত্তিটা পেলে সেটা তার কাছে একটা অনাকাঙ্খিত বিষয় তো হবেই বাবা মা ও নিশ্চই খুশিই হবেন । তখন একটা সামান্য সাইকেল দেওয়া তাদের জন্য এমন বিচিত্র কিছু হবে না । জাবেরর মনে এতটুকু ক্ষীণ আশা ছিলই তাই সে বছরের প্রথম থেকে পড়াশুনায় বেশ মনোযোগ দিয়েছিল ।

সে বছর জাবের সরকারী বৃত্তিটা পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার আশাটা আর পূর্ণ হয় নি । সাইকেল নিয়ে প্রাইভেটে ব্যাচে যাওয়ার , এই একটু বিকেল বেলায় নদীর ধারের রাস্তাটা দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সাধটা তার অচিরেই মারা পড়ল । সাইকেল নিয়ে শহরের ব্যস্ত গাড়িঘোড়ার রাস্তায় চলতে সমস্যা হবে , পড়াশুনা কমিয়ে সারাদিন পইপই করে ঘুরবে এরকম নানান অজুহাত দেখিয়ে বাবা মা আর সাইকেলের রাস্তায় গেলেন না । সাইকেলের বদলে একটা সোনার চেইন কিনে দিলেন জাবেরকে । সোনার চেইনটা নিয়ে জাবের এক মহা সমস্যায় পড়ল । একে তো সে পুরুষমানুষ আর পুরুষমানুষের সোনাই যেখানে পরা ধর্মমতে ঠিক নয় তখন এই অল্প বয়সেই কেন তাকে এরকম একটা চেইন পড়তে দেয়া হল এটার কোন কূল-কিনারা করতে সে করতে পারল না । তারপরেও সোনার এই চেইনটা পড়তে সে রাজী ছিল , রাস্তাঘাটে সে দু-একজনকে এরকম চেইন পরে ঘুরতে দেখেছে কিন্তু বিপত্তি বাধাল চেইনের সাইজটা । চেইনটা এত বড় যে বলতে গেলে তার নাভি পর্যন্ত চলে আসে । বাবা মা দিয়েছেন কি আর করা যাবে চেইনটা সে তাই দু-চারদিন পরল । কিন্তু বন্ধুদের যন্ত্রনা যখন চরমে পৌছাল তখন মাকে চেইনটা দেওয়া ছাড়া তার আর কোন উপায় রইল না । মা ও চেইনটা কোন কথা ছাড়া নিয়ে নিলেন । কে জানে হয়ত নিজের জন্যই কিনেছিলেন ! জাবের এটাই ভাবল আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল বাবা মার কোন প্রতিশ্রূতির আশা করা যাবে না । সান্ত্বনার একটা উপলক্ষ্য অবশ্য সে কয়েকদিন পরেই পেয়েছিল । নীল পাথর বসানো সোনার একটা আংটি দেওয়া হল এবার তাকে । অফিস থেকে ফিরে কলার থোড়ের মত লাল একটা বাকসের ভিতর থেকে আংটিটা বের করেছিলেন বাবা। আংটিটা পেয়ে জাবের একটু অবাকই হল । আংটির পাথর সাধারণত হাল্কা নীল বা খয়েরী বর্ণের হয় । তারটা গাঢ় নীল বর্ণের কেন এটা সে কিছুতেই বুঝতে পারল না । অবশ্য এই আংটিটার জন্য যে তাকে সামনের জীবনে খানিকটা ঝামেলা পোহাতে হবে তা তখনও সে জানত না ।

জাবের আংটিটা অনামিকাতেই পড়েছিল । অবশ্য কেউ তাকে সে সময় বলে দেয় নি অনামিকায় আংটি পরার একটা অন্য অর্থ আছে । ছোট বলেই হয়ত কেউ বলেনি । তবে যে সময় সে প্রথম কথাটা শোনে সে সময় সবেমাত্র তার সর্বনাশ হতে শুরু হয়েছে এবং এটা থেকে পরিত্রানটা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে ।

কলেজে পড়ার সময়ই জাবের বাবাকে হারায় । পরের কয়েকটা বছর তাই সে খুব একটা সুবিধার মধ্যে পার করতে পারে না । বাবার সামান্য পেনশনের টাকায় নিজের , ছোট ভাইদের পড়াশুনা আর পরিবারকে চালিয়ে নিতে তাকে হাপিয়ে উঠতে হয়,ধরতে হয় টিউশনি । এসময় একেকটা দিন যেন একেকটা বছর মনে হতে থাকে তার কাছে । অবশ্য এ অবস্থায় তাকে বেশীদিন কাটাতে হয়নি । গ্রামের বাড়িতে নদীর মধ্যে থাকা জমিগুলো চর হয়ে জেগে ওঠাতেই যা রক্ষে । ওসব আধিয়ারদের দিয়ে যা টাকা-পয়সা পাওয়া যায় তাতে ওদের ভালই চলতে শুরু করে । ক্রান্তিকালের ঐ কয়েকটা বছরে তাকে দেখে হয়ত সবাই খানিকটা সহানুভূতিতে ভুগত , তাই হয়ত অনামিকার আংটিটার দিকে কেউ নজর কেউ কখনও দেই নি ।

অনামিকার আংটিটার দিকে যাদের নজর দেয়ার কথা ছিল তারাই অবশ্য প্রথম নজর দেয় , বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা । কিসের জন্য আংটি পরেছিস ? বিয়ে করেছিস ? এগেজড ? নাইলে কে দিল ? নানান প্রশ্ন । প্রথমদিকে অবশ্য সবাইকে সে খানিকটা সময় নিয়ে আংটির বিষয়টা বলত পরে হাল ছেড়ে দিয়েছে । হেসে বলে হ্যাঁ বিয়ে করেছি বা বিয়ে হবে হবে করছে । যদিও বিয়ে করা বা বিয়ে হবে হবে করা থেকে সে অনেকটা দূরেই ছিল সবসময় । আংটিটার জন্যই কিনা কে জানে মেয়েরা তার সাথে কখনো ভালভাবে মেশে নি !

একবার সে অবশ্য আংটিটা খোলার কথাও ভেবেছিল কিন্তু প্রায়াত বাবার শেষ স্মৃতির কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত খুলতে পারে নি । তবে অনামিকায় থাকাতেই যখন সমস্যা তখন এটাকে অনামিকা থেকে খুলে মধ্যমা বা অন্যকোন আঙুলে পরার কথাও সে একবার ভেবেছিল । শেষ পর্যন্ত এটাও হয়নি । সাত-আট বছর আগে পরা আংটি । এতদিনে তার বয়স বাড়ার সাথে সাথে আঙুলের বয়সও বেড়েছে , বেশ মোটাই হয়েছে আঙুল । অন্য আঙুলে পরা তো দূরের কথা সাবান দিয়ে ঘঁষেও অনামিকা থেকে আংটিটা খুলতে পারেনি । অবশেষে সে হাল ছেড়ে দিয়েছে , মনস্ত করেছে থাকুক অনামিকাতেই থাকুক বাবার স্মৃতিটা । বিয়ে করলে দরকার হলে বিয়ের আংটিটা অন্য আঙুলেই পরবে । আংটিটার যত্নেরও সে কোন ত্রুটি করে নি । দীর্ঘদিন ব্যবহারে আংটির গাঢ় নীল পাথরটা খনিকটা বিবর্ণ হয়ে গেলে সে এটাকে পাল্টিয়ে গাঢ় নীলের একটা পাথর বসিয়ে নিয়েছে ।

এমনিতেই আংটিটা নিয়ে জাবেরের কোন সমস্যা ছিল না , দুই একজন মজা করে বিয়েসাদি নিয়ে এটাওটা বলে তো বলুক সমস্যা নেই কিন্তু জাবেরের অন্য একটা কাজে আংটিটা বাধা হয়ে দাড়াল । বিয়ে করার জন্য জাবেরের একটা মেয়ের সাথে খনিকটা পরিচিত হওয়া বা আরও ব্যাপকভাবে বলতে গেলে প্রেম করা খুব দরকার হয়ে পড়েছিল । জাবেরের বাবা মা সেই কোন দশকের রক্ষনশীল সমাজে প্রেম করে বিয়ে করেছিল । তাই এই দশকের ছেলে হিসেবে তারও প্রেম করে বিয়ে করা বা নিদেনপক্ষে কিছুদিন জেনেশুনে একটা মেয়েকে বিয়ে করা প্রায় কর্তব্যের মধ্যে পড়ে । জাবের এটা বুঝেছে , বেশ ভালোভাবেই বুঝেছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্যায়ে এসে এটাও বেশ ভালভাবেই বুঝেছে যে স্বাভাবিকভাবে যেভাবে প্রেম বা ভাবভালবাসা হয় তার এভাবে ওরকম কিছু হবে না , বিশেষত এ পর্যন্ত তার যখন কোন বান্ধবি পর্যন্ত কেউ একজন নেই ।

অগত্যা নিরূপায় তরুনের শেষ পথ হিসেবে সে ইন্টারনেটকেই বেছে নিয়েছে । আর কে না জানে এসব পথে জাবেরের মত তরুনদের জন্য মেয়েদের অভাব কখনো হয় নি । জাবেরেরও অবশ্য খুব একটা সময় লাগেনি । কিছুদিন একজনের সাথে ভাল ঘনিষ্টতার পর একজন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল আজকালের ছেলেদের মত সে কানে সোনার দুলটুল পরে কি না ? জাবের নির্দোষ জবাব দিয়েছিল সেটা সে পরে না তবে সোনা যে একেবারে পরে না তা নয় একটা আংটি পরে । মেয়েটা জানতে চেয়েছিল কোন আঙুলে সে আংটিটা পরে । জাবের হুট হাট মিথ্যা বলতে পারে না অথবা সে ভেবেছিল আঙুলের কথাটা বলুক পরে কারনটা বলবে । কিন্তু মেয়েটা অনামিকার কথাটা শোনার পর আর বেশী দেরী করে নি । জাবের অবশ্য যোগাযোগের চেষ্টা খনিকটা যে করে নি তা নয় , লাভ হয়নি । জাবের সান্ত্বনা খুঁজেছে । ক বলতে কলিকাতা শোনার অভ্যাস এ দেশের লোকজনের বহু দিনের স্বভাব , খামাখা মেয়েটাকে দোষ দিয়ে কি লাভ ? অবশ্য জাবেরের মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিল । পাশ করার পর অফিসে-আদালতে নিশ্চই হবে , কিছু একটা হবে । কিন্তু সে সবে গিয়ে সে দেখেছে কেউ আর তাকে বিয়ের কথাই জিজ্ঞাসা করে না । হয়ত এটা একটা খুবই ব্যক্তিগত একটা প্রশ্ন , জিজ্ঞাসা করতে লোকজনের রুচিতে বাঁধে অথবা সবাই তার অনামিকাতে আংটি দেখে বুঝেছে সে বিবাহিত । কেইবা জানে এই কুফা আংটির ফল তাকে কতদিন বয়ে বেড়াতে হয় ?

রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০০৮

যাপিত জীবন-০৪ : : একটি বিয়ে ও কুফাকাহিনী

১। বন্ধুর বোনের বিয়ে । আমাকে ফোন করে বলল আমি যেন ঠিক সাড়ে ছটায় সেগুনবাগিচাতে কমিউনিটি সেন্টারে যাই । আমি বললাম ঠিক আছে । আমি আবার কাউকে কোন সময় দিলে ঐ সময়ের আগেই চলে যাই, স্বভাবের দোষ । এবারও রওয়ানা হলাম আধঘন্টা আগে মানে ছটায় । সেগুনবাগিচাতে গেলাম , বন্ধু আমাকে যে কমিউনিটি সেন্টারের নাম বলে দিয়েছিল সেটা কষ্ট করে খুঁজেও বের করলাম । কমিউনিটি সেন্টারে দেখি অন্তত বিয়েবাড়ির কেউ নেই , কিছু লোকজন আছে টেবিল চেয়ার ঠিক করছে ঝাট-টাট দিচ্ছে এটা সেটা। আমি ভাবলাম কি ব্যাপার ভুলভাল জায়গায় চলে এসেছি নাকি । বন্ধুকে ফোন দিলাম । সে বলল একটু ঝামেলা হয়ে গেছে আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই নাকি সবাই আসবে । আমি ভাবলাম হৈছে , এতদিন জানতাম আমন্ত্রিত অতিথিরা আসে বিয়ে হওয়ার সময় বা বিয়ে শেষ হওয়ার পর । টুপ করে খেয়ে উপহার সামগ্রী দিয়ে কেটে পড়ে । এই প্রথম দেখলাম কেউ একজন(মানে আমি আরকি) আসছে বিয়েবাড়ীর লোকজন আসার আগে । যাক এসেই যখন পড়েছি চারপাশে একটু চক্কর দিলে কেমন হয় । কমিউনিটি সেন্টারটার পিছনে গেলাম । ওখানে দেখি কিছু লোকজন মুরগীর চামড়া ছিলছে , কেউবা আলু-টালু জাতীয় জিনসপত্র কাটছে । আমি ভাবলাম হইছে , খাওয়া আজকে হবেনে ! এই জিনিসগুলা মাত্র ছিলতেছে। এরপর রান্না হবে । সেই বান্না আবার খাব । বুঝছি রাত দশটার আগে আর খাওয়া জুটবে না কপালে । বন্ধুর উপর রাগ হল । শালা , ডাকলিই যখন এত আগে ডাকলি ক্যান, আটটার সময়ে ডাকলেও তো পারতি , এমন সময়ে ডাকছস সবার আগে এসে হাজির হইছি !

২। পকেটে আমার সাকুল্যে ছিল পাঁচশত টাকার একটা নোট আর খুচরা বিশ টাকার মত । ভাবলাম খেতে তো দশটার মত বাজবে , যাই ফাঁকে বিকেলে কিছু খেয়েও আসি আর পাঁচশত টাকার নোটটাও ভাঙ্গায়ে নিয়ে আসি , রাত্রে তো আবার বিকশাওয়ালা এখান থেকে পলাশী ত্রিশ টাকার কমে যাবে না । কমিউনিটি সেন্টারের পাশেই একটা দোকানে গেলাম । সিংগারা , সমুচা আর কফি খেয়ে তেইশ টাকা বিল হল । পাঁচশত টাকার নোটটা ধরায়ে দিলাম দোকানদারের হাতে । নোটটা দেখে দোকানদার যেন আকাশ থেকে পড়ল । ভাংতি দেই কেমনে , ভাংতি ছিল কিন্তু কয়েকজন দোকান থেকে বড় অংকের টাকা ভাঙ্গায়ে নিয়ে গেছে , বেচাবিক্রি নাই তাই ভাংতি টাকা থাকে না -- এইসব নানান আবজাব কথাবার্তা । আমি মনে মনে ভাবলাম হৈছে ভাই আপনে আমার ভাংতি টাকাগুলাই নেন , এইসব আমারে শুনায়েন না , এমনে নিজেই নানান কষ্টের মধ্যে আছি । দোকানে পকেটের সব খুচরা টাকাগুলো দিয়ে পাঁচশ টাকার নোটটা নিয়ে ফেরত আসলাম । ভাবলাম শুরু হইছে , আজকে কুফা শুরু হইছে , আরও কত কি হয় কে জানে ? না , কুফাকাহিনীর পরবর্তী অংশের জন্য বেশীক্ষন অপেক্ষা করতে হল না ।

৩। সাড়ে সাতটার দিকে লোকজন আসা শুরু করল । আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও দেখলাম দল ধরে একটা গ্রুপ আসল , অধিকাংশই চেনা । এদিক ওদিক মান্জা মেরে হাটছি এমন সময় এক জুনিয়র এসে বলল ভাইয়া আপনি একটা লুপ মিস করছেন । আমি বললাম কিসেরইবা লুপ আবার সেটা আবার মিসইবা কি ? সে বলল প্যান্টের বেল্টটা নাকি যে লুপগুলোর মধ্য দিয়ে যায় সেগুলোর একটার উপর দিয়ে গেছে , দেখতেও নাকি বাজে লাগছে খুব । বাথরুলে গিয়ে বেল্টটা ঠিক করে আনলাম । রে কুফা রে!

৪। বরমশায় আসলেন আটটার দিকে । বিয়েশাদি হয়ে খাওয়া-দাওয়া আসতে আসতে নয়টার মত বেজে গেল । প্রথম শিফটেই বসলাম । তাড়াতাড়ি খেয়ে-দেয়ে কেটে পরি । পরেরদিন আবার ল্যাবের আ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে , হাফ কাজ বাকী আছে । বন্ধুরা মিলে সবাই একসাথে বসলাম । খাবার মাত্র পবিবেশন শুরু হয়েছে এমন সময় আমাদের দাওয়াতপ্রদানকারী বন্ধুসাহেব আসলেন । দুইজন লোক নাকি আছে তাদের খুব তাড়া আছে ,এখুনি খেয়ে বিদায় নিতে হবে , জায়গা নেই । অগত্যা আমি আর একজন বন্ধু টেবিল থেকে উঠলাম । যাক আমরা না হয় একটু পরেই খাই । এদিক ওদিক হাটছি । ভাবলাম যাই এই সুযোগে পাঁচশ টাকার নোটটা খুচরা করে নিয়ে আসি ।রাস্তার দোকানপাট অধিকাংশই বন্ধ । টাকাটা খুচরা করতে আধঘন্টাখানেক লাগল । ফিরে দেখি দ্বিতীয় শিফটটা অলরেডী শুরু হয়েছে এখন তৃতীয় শিফটে বসতে হবে । তৃতীয় শিফটে খব বেশী লোক ছিল না , জনাষাটেক হবে হয়ত । এই জনাষাটেক লোক আমরা ছয়- সাতটা টেবিলে হাত-টাত ধুয়ে বসলাম । বসলাম তো বসলামই খাবার আর আসে না । মিনিট ত্রিশেক পার হয়ে গেল খাবারের কোন হদিস নাই , বন্ধু ব্যস্ত হয়ে আছে বর-কনের সাথে ভিডিওধারিত হতে । অনেকক্ষন পর তার নাগাল পাওয়া গেল । বললাম খাবার কৈ অনেকক্ষন থেকেই তো বসে আছি । সে বলল অনুমানের চেয়ে বেশী লোক দাওয়াতে এসেছে , খাবার মোটামুটি শেষ । বাকী লোকের খাবারের ব্যবস্তা নাকি হচ্ছে । বন্ধুবান্ধবরা যারা এসেছিল তারাও ইতোমধ্য বিদায় নিল । আমরা আরও কিছুক্ষন বসলাম ।অবশেষে খাবার আসা শুরু হল । হাত আবার ধুয়ে এসে টেবিলে বসলাম । কিন্তু কুফা যে আরও কিছু বাকী ছিল এটা জানতাম না । ঠিক আমাদের টেবিলটার সামনে এসে রোষ্ট-টোষ্ট , ভাজা মাংস ইত্যাকার খাদ্য শেষ হয়ে গেল । হাতধোয়াটা আবার মনে হয় বিফলে যায় ! এমন সময় দেখি বন্ধু আসছে । বললাম ধুর মিয়া এখনও তো খাবার পাইলাম না । মেজাজ তখন সহ্যক্ষমতার চূড়ায় উঠেছে । সে বলল এদিক-ওদিক দিয়ে জোড়াতালি দেওয়া খাবারও নাকি শেষ । এদের একটা চায়নিজ খাবারের রেস্তোরা আছে সেই আইটেমগুলোই এখন দেওয়া হবে। প্রসেসিং চলতেছে , সামান্য একটু আর বসতে হবে । আমি ভাবলাম ওরে ভাই ! চায়নিজই যখন খাওয়াবি আমাদের দুইজনকে হাতে কিছু টাকাপয়সা ধয়ায়ে দে আমরা বাহিরে গিয়ে খেয়ে চলে যাই । খাবারের জন্য এতক্ষন বসে থাকতে ভাল লাগছে না । আরও কিছুক্ষন বসার পর বহু প্রতীক্ষার খাবার চলে এল । তৃতীয়বারের মত হাত ধুয়ে আসলাম । এবার আর কোন ভুল করলাম না আমরা , ওয়েটারের সাথে গিয়ে ওয়েটার যে টেবিলে খাবার রাখল সেখানেই জায়গা করে বসে পড়লাম । খাওয়ার সময় বন্ধুটা বলল তাড়াতাড়ি করে রান্নাবান্না করা হয়েছে জন্য নাকি রান্নাটা ভাল হয়নি বিশেষ করে মুরগীর পদটা নাকি খানিকটা অর্ধসিদ্ধই রয়েছে । আমার তখন এইসব আর শোনার সময় নাই । কাচা -টাচা যাই পাচ্ছি তাই গোগ্রাসে গিলে চলেছি ।

ঘড়িতে তখন সময় সাড়ে এগারোটা , কমিউনিটি সেন্টারটা ততক্ষনে মোটামুটিভাবে ফাঁকা হয়ে গেছে ।

শনিবার, ২ আগস্ট, ২০০৮

যাপিত জীবন -০৩ : : বুয়েটের কাহিনী

১। অ্যালগরিদম ক্লাসে স্যারের কাছে শোনা গল্প । স্যার গিয়েছেন কানাডার ওয়াটারলুতে পি,এইচ,ডি করতে । স্যারের সম্বল বলতে বাংলাদেশের শিক্ষাবোর্ড আর বুয়েট থেকে নেয়া গুটিকয় ডিগ্রী , মাথায় সর্বক্ষন পরে থাকা একটা ক্যাপ আর ইংরেজী ভাষার আধামাধা জ্ঞান । তো স্যার তার অতিপ্রিয় ক্যাপটা পরে প্রথমদিন দেখা করতে গেছেন তার পি,এইচ,ডি সুপারভাইসরের সাথে । সুপারভাইসর খুবই মাইডিয়ার টাইপের লোক । স্যারকে দেখেই বললেন what's up? . অর্থ বোঝার জন্য স্যার বাক্যটার সিনট্যাকটিক অ্যানলাইসসিস করলেন । ভাবলেন what মানেতো কি আর up মানে উপরে সুতরাং বাক্যটার অর্থ হবে উপরে কি ? তো স্যার উত্তর দিলেন it's a cap ! ( স্যারের মাথার উপরে ক্যাপই যেহেতু ছিল ! ) । কথাটা শুনে ওনার সুপারভাইসর হেসে উঠলেন । স্যারের মুখ থেকে গল্পটা শুনে আমরাও হেসে উঠলাম ।

২। থার্ড ইয়ারে কম্পাইলার ক্লাস চলছে জোরসে । এক চ্যাপ্টারের দুইশ ষাট খানা স্লাইড স্যার অনবরত পড়িয়েই যাচ্ছেন । আমি ফার্ষ্ট বেন্চে বসে খুব মনযোগী হয়ে স্লাইড দেখার আর মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক মাথা নেড়ে বুঝতে পেরেছি এমন ভান করছি ( এই স্যারের ক্লাসে এই ভানটা করতেই হয় না হলে হুট করে স্লাইড থেকে প্রশ্ন করে বিপদে ফেলে দেন ক্লাসে !) । দুর্দান্ত গতিতে ক্লাসখানা এগিয়ে চলছে এমন সময় কারেন্টটা চলে গেল । নিজের অজান্তে আমি বলে উঠলাম শিট ! না , ক্লাসটা ইন্টারাপ্টেড হল এজন্য বললাম না , বললাম কারেন্ট চলে যাওয়ায় ফ্যানগুলো বন্ধ হয়ে গরম লাগা শুরু হল এজন্য । আমি শিট মানে জানতাম ধুর , দুরো এরকম অর্থে কিন্তু স্যার কি অর্থে এটা জানতেন তা জানলাম একটু পরে । স্যার আমার পাশের জনকে ধরলেন , বললেন এই মাত্র তুমি যে কথাটা বললে এটা কি একজন শিক্ষকের সামনে ক্লাসে বলা ঠিক হল । আমার পাশেরজন আকাশ থেকে পড়ল । সে কিছুই বলেনি আর আমি যে কিছু বলেছি সেটাও সে শোনে নি । আমি তো বুঝতে পারছি স্যার কি বলতে চাচ্ছেন , ইয়া নফসি ইয়া নফসি করতে লাগলাম আমি । স্যার আমার পাশের জনের বিস্মিত মুখের দিকে চেয়ে বলতে লাগলেন আমার স্কুলে পড়া ছেলেও মাঝে মাঝে এটা বলে ,ওকে এটা বলা ছাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে । আশা করি তুমিও শিক্ষকের সামনে এ ধরনের কথা কখনও বলবে না । পাশের জন কিছু না বলে , কিছু না বুঝে আবাল হয়ে বসে থাকল । আমি ভাবলাম যাক বাঁচলাম !

ডিকশনারীতে শিট শব্দটার মানে কি ? বানান জানিনা বলে খুঁজতে পারিনি । একটা আছে sheet যেটার মানে কাগজের তা ,এটাতো স্যারের বোঝা শিট নয়ই। ক্লাসের একজন বলেছিল শিট মানে পচাঁ গু(!) । কতদূর সত্য কে জানে !

প্রাকৃত

মফা আর সাবেতের সাথে বৃদ্ধ দুইজনের দেখা হয় এক গরমের রাতে মফস্বল শহর থেকে সামান্য দূরে গ্রামের নিকটবর্তী একটি কালভার্টে ।

শীতের শেষে কেবলমাত্র গরম পড়তে শুরু করেছে । সারাদিন সূর্যের চরম চোটপাট । বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে রাস্তায় লোকজন কমতে শুরু করে । সরকারী-বেসরকারী অফিসের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা একটু বর্হিমুখী টাইপের তারা এসময় অফিস থেকে বাসায় ফিরে কাপড়-চোপড় বদলে সামান্য চা-নাস্তা খেয়ে বেড়িয়ে পড়ে । কেউ কেউ আড্ডা জমায় বইয়ের লাইব্রেরীতে , কাপড়ের দোকানে , ফার্মেসীর ভিতর ও বাহিরের টুলগুলোতে আবার কারো কারো আড্ডার স্থান হয়ে ওঠে হাটের সামনের চায়ের দোকানগুলো । গ্রামের লোকজন যারা হাট করতে এসেছিল মফস্বল শহরে তারা বাড়ীর দিকে পা বাড়ায় , কাঁচা বাজারের দোকানগুলো বন্ধ হতে শুরু করে । সারা দিন নানান কাজের পর শহরটা যেন ঝিমানোর প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে । শুধু ব্যস্ততা বাড়ে চামড়া ব্যবসায়ীদের । সারা বিকেল গরু-ছাগলের চামড়া কেনার পর এসময় এরা হিসাব নিয়ে বসে । বিশাল আড়তের কাঁচা চামড়ার কটা গন্ধের মধ্য বসে কর্মচারীরা চামড়া টান টান করে বেঁধে লবন ছিটাতে থাকে । কাল ঢাকা থেকে মহাজন এসে ট্রাক ভরে চামড়া নিয়ে যাবে । আড়তে মহা ব্যস্ততা । ঠিক এই সময়ে নিয়ম করে দুঘন্টার জন্য বিদুৎচলে যায় প্রতিদিন । সেচের মৌসুম শুরু হয়েছে । প্রত্যন্ত অন্চলে চলে গেছে বিদুৎ। স্যালো মেশিনের পানি তোলা হচ্ছে বিদুৎদিয়ে । এইসব মফস্বলে দেয়ার মত কারেন্ট কৈ ?

কারেন্ট চলে গেলে শহরটা যেন আবার সন্ধ্যার পরের ক্ষনিক নিস্তব্ধতা থেকে আবার জেগে ওঠে । প্রতিটা বাসায় হারিকেন-মোমবাতি জ্বালানো শুরু হয় । স্কুল কলেজের ছাত্ররা পড়ার টেবিল থেকে বেড়িয়ে পাড়ার মোড়ে জড়ো হয় , স্থানে স্থানে সংঘবদ্ধ হয়ে আড্ডা দেওয়া শুরু করে । যাদের বাড়িতে ছাদ আছে তাদের বাড়িতে মহিলা-মেয়েরা ছাদে জড়ো হয়ে গল্প-গুজব করে । সারা দিনেই টিভি ছাড়া এটাই এদের একমাত্র বিনোদন।

মফা আর সাবেতের এ সময়টাই ভাল লাগে । এমনিতেই সারা দিন সূর্যের তাপ শূষে নিয়ে বাড়িগুলো গরম হয়ে থাকে । কারেন্ট না গেলে বাড়িতে থাকাই সমস্যা হয়ে যেত । দুইবার করে ডিগ্রী ফেল করে এরা অনেকদিন নিজেদের বাড়িতেই বোঝা হয়ে ছিল । তখন অন্যদের গরম তো এদের উপর পড়তই । এখনও অবশ্য এদের উপর গরম পড়ে তবে সেটা বাড়ির না বাজারের । শহরের কুদ্দুস মোল্লার হাটগুলোতে এরা ইজারা তোলো । কুদ্দুস মোল্লা ঝানু ব্যবসায়ী । শহরের দুই দিন বসা হাট ছাড়াও এনার ইজারা নেয়া আছে শহরের একটু বাহিরে গ্রামের দিকের দুটা হাট । মফা আর সাবেত আরও অন্যদের সাথে এই হাটগুলোতে হাটের দিন দোকানদারদের কাছ থেকে ইজারা তোলো কুদ্দুস মোল্লার পক্ষ হয়ে । শুধু কি দোকানদার , এসব হাটের গরু-ছাগল বিক্রির চালানের টাকাও রশিদ দিয়ে তোলো গরু-ছাগলের মালিকের কাছ থেকে । গরু-ছাগলের মালিকেরা বদের একশা । আপসে গরু-ছাগল বেচে চালানের টাকা না দিয়েই সটকে পড়ার ধান্দায় থাকে । মফা আর সাবেত পালাক্রমে একজন হাটের নির্দিষ্ট জায়গায় চেয়ার টেবিল আর চালান রশিদ নিয়ে বসে থাকে আর একজন চালানের রশিদ হাতে নিয়ে অনবরত ঘোরে হাটে , কোথাও কোন দরাদরি নজরে পড়লে দূর থেকে লক্ষ্য করে । গরু-ছাগল বেচে লোকজন চালান করলে ভাল , না করে সটকে পড়ার ধান্দা করলেই গিয়ে ধরে - দে জরিমানা দুইশ টাকা ! কাচা বাজারের দোকানদাররা আবার এইদিক দিয়ে ভাল , জিনিসপাতি বেচাবিক্রির নির্দিষ্ট জায়গা আছে । প্রতিদিন এরা ঐ জায়গাতেই বসে । এদের নিয়ে মফা আর সাবেতের কোন ঝামেলা হয়না । সন্ধ্যার পর দোকান ওঠানোর আগে ইজারার টাকাটা তুললেই হল । সপ্তাহে তিন হাটের ছয় হাটবাড়ে মফা আর সাবেতের তাই প্রচন্ড ব্যস্ততা । হাটের হাজার রকমের মানুষের মাঝে মিশে ধুলা বালি আর গনগনে সূর্যের মাঝে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে এদের দিন কেটে যায় । দুপুরের আগ পর্যন্ত এরা অবশ্য ফাঁকাই । তখন কাজ বলতে কেবল প্রিতমের সেলুনে বসে ডিস্টিক্ট শহর থেকে বের হওয়া তিন টাকার নিউজপ্রিন্টের দৈনিক আজকের খবর পড়া আর আওয়ামীলীগ-বিএনপি , ইরান-আমেরিকা নিদেনপক্ষে ঘোড়াশালে নতুন পীরের পানি পড়া দিয়ে নানান ব্যায়াম নিরাময়ের ঘটনা অথবা দুলুর বাড়িতে চোরের জিনিসপত্রের সাথে ঘরে রাখা আধাখাওয়া কাঁঠাল নিয়ে যাওয়ার কথা নিয়ে এর ওর সাথে আলাপ করা ।

বাজার থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই মফা আর সাবেতের সন্ধ্যা গড়িয়ে যায় আর কারেন্টটাও যায় এসময় । এরা তখন লুঙ্গি আর টিশার্ট পরে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে হাটতে । হাটা বলতে প্রতিদিন আসলে একই রাস্তায় হাটা । বাড়ির সামনে দিয়ে গ্রামের দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটা দিয়ে পনের-বিশ মিনিট হাটলে একটা ভাঙ্গা কালভার্ট চোখে পড়ে । মফা আর সাবেত প্রতিদিন এই রাস্তাটা ধরেই হাট থেকে গ্রামের দিকে ফিরে যাওয়া হাটুরেদের সাথে হেটে যায় কালভার্টটা পর্যন্ত । এটা বলতে গেলে শহর আর গ্রামটার সঙ্গমস্থল । বাড়িঘর তেমন একটা এদিকে নেই । দুই পার্শ্বে ফসলী জমি । কালভার্টটার উত্তর দিক থেকে এ সময় হু-হু করে বাতাস আসে যেন মনে হয় এটা ভেঙ্গেই যাবে । মফা আর সাবেতের বেশ লাগে বাতাসটা । ওরা সাধারণত কালভার্টটার একপাশে যেখানে বড় করে লাল রং দিয়ে জাকির প্লাস সবুরা লেখা আছে সেখানটাতেই প্রতিদিন বসে । হাটুরে লোকজনের কথাবার্তা শুনতে শুনতে দুজনে হাল্কা-পাতলা বিষয়-আশয় নিয়ে কথাবার্তা বলে । কখনও কখনও এদিকটায় আরও লোকজন হাওয়া খেতে আসলে তাদের সাথে কথা বলে ।

আজকে দিনটায় আকাশে অল্প-স্বল্প মেঘ ছিল । হাওয়াও পাওয়া যাচ্ছিল বেশ । কালাভার্টটাতে সাকুল্যে চারটি প্রাণী । মফা আর সাবেত রং দিয়ে লেখা জায়গাটাতেই বসেছিল । কালভার্টটের অন্যপার্শ্বে ছিল দুজন বৃদ্ধ ,পরনে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেন্জী । এরা পার্শ্বের গ্রামেরই হবে বোধহয় । মফাই প্রথম কথা বলতে শুরু করে এদের সাথে ।
-চাচা খবরাখবর ভাল ।
-আর খবর জিনিসপত্রের যে দাম । মনে করেন যে আলুভর্তা আর ডাল দিয়া তিনবেলা খাবার খালেউ চলতিছে না ।
-জিনিসের দাম তো বাড়বিই ত্যালের যে দাম বাড়তিছে ।
-হামরা তো বাপু এত কিছু বুঝিনে । আগে দিন চলতিছিল ভালোই এখন আর চলতিছে না কতা এটেই ।
পাশের বৃদ্ধ বিড়বিড় করে সূরার মত কি যেন পড়ছিলেন । এবার তিনিও মুখ খোলেন ।
- আসল কতাটা হল ঈমানের পরীক্ষা চলতিছে দুনিয়াত। আল্লাতো তো কছেই দুঃখ কষ্ট দিয়ে বান্দাক পরীক্ষা করা হবি দুনিয়াত ।
-কিন্তু খিরিসটান-নাসারারাই যে সুখ করল দুনিয়াত । ওমাগের পরীক্ষা নাই ।
- ওমাগের তো দুনিয়াতি সককিছু , আখেরাত তো নাই । সুখতো করবিই ওমরা দুনিয়াত । ফলও পাবি , দুনিয়াতও পাবি এদিক-ওদিক দিয়ে আবার পরকালততো পাবিই। ক্যা তোমরা শেঙ্গলডাঙ্গার ঘটনাটা শোনেন নাই ।
-না কি হছে শেঙ্গলডাঙ্গাত । সাবেত জবাব দেয় ।
বৃদ্ধের মুখ চাঁদের আলোয় চকচক করে ওঠে । সেখানে একটা গল্প বলার আভাস পাওয়া যায় ।
- দিন দুনিয়ার খবরাখবর তোমরা থুবা না । সেদিনের ঘটানাই তো শেঙ্গলডাঙ্গার । এলাকাত তো হইহই পড়ে গেছিল । খবর পাননি তোমরা ?
মফা আর সাবেত একে অপরের দিকে তাকায় । না শেঙ্গলডাঙ্গার এরকম কোন খবর জানা নাই তাদের । মফা বলে ঘটনাটা কি চাচা কন তো দেখি শুনি ।
- শেঙ্গলডাঙ্গা এলাকাটা কবার গেলে খুব একটা কিন্তুক ভাল নয় । সারা উপজেলার মধ্যে ওটি মনে করেন যে হিন্দু-খিরিসটান বেশী । খিরিসটান মানসের গিরজা না কি করে কয় ওটাও আছে একটা । সারা বছর নানান জাগাত থেকে মানুষজন আসে , এটা সেটা লাগিই আছে । ঈমান কালামের অবস্থা কবার গেলে কিছুই নাই ঐ এলাকার মানসের ।
-তাই নাকি ? সাবেত বলে । নিজের উপজেলার মধ্যে এরকম একটা এলাকা আছে ও জানত না ভেবে অবাক হয় সাবেত ।
- তোমরা তো সেদিনের ছল-পল কি আর কবার পাবা এগোর কতা । হামরা এগোক দেকতিছি জন্ম থেকে । হামার নানিবাড়ীও আছিল শেঙ্গলডাঙ্গাত । ছোটত যায়া হামরা কত কীর্তিকলাপ দেখছি খিরিসটানের । অন্যবৃদ্ধও ঢুকে পড়ে কথার মধ্যে ।
মফা আর সাবেতের কৌতুহল আরো বাড়ে । দুজন একসাথে বলে ওঠে তারপর কি হল শেঙ্গলডাঙ্গাত ।
গল্প বড়া বৃদ্ধ কোমড় থেকে লুঙ্গির মধ্যে গুজে রাখা মেস ও বিড়ির প্যাকেট বের করে । তাজবিড়ির প্যাকেটটা থেকে একটা বিড়ি নিয়ে বাতাসের হাত রক্ষা পাওয়ার জন্য মাথা নিচু করে কৌশলে দেশলাই দিয়ে বিড়িটা ধরায় । এরপর আবার সে ঘটনাটা বলতে শুরু করে ।
- শেঙ্গলডাঙ্গার এক বড়লোক বিরাট বাড়ি বানাল । মানুষটাক হামরাও চিনতেম । সূদের কারবার আর ভেজাল ঔসধের ব্যবসা করে অনেক টেকা কামাই করছিল । মানসে ওক কত সূদে মনসূর । সেই সূদে মনসূরের বাড়িত যায়া মানসে রাড়ি দেখে হায়হায় করে । হায় হায় এত টেকা খরচা করে কেউ বাড়ি বানায় ! সূদে মনসূরও খুব খুশি । বাড়ির নাম দিল বেহেশতের বাড়ি । তোমরাই কও এটা কওয়া কি ঠিক হছিল । দুনিয়ার মানসের কি সামর্থ্য আছে বেহেশতের বাড়ি বানাবার ?
কালভার্টের চারটি লোক দুনিয়ার সামান্য লোকের এ অপার্থিব দাবিতে সমস্বরে হেসে ওঠে । কালভার্ট পার হয়ে যাওয়া হাটুরে লোকগুলোও পিছনে ফিরে দেখে কি হল । অনেকক্ষন পার হলেও তাদের হাসি থামে না । বৃদ্ধ আবার গল্প বলতে শুরু করে ।
- চারপাশের মানুষ না হয় কিছু না কবার পায়া থামে থাকল । আল্লাতো তো থামে থাকপে নায় । হলও তাই । একদিন ডিগিত থেকে একটা বান্দরের মতন কি জানি উটে আসল একটা । অনেকে কয় বান্দর অনেকে কয় বাঘ । সেটার নাকি যে সে শক্তি নয় ! সবার আগত গেল মনসূরের বাড়িত । ভায়ে দেখলে বিশ্বাস করবে নও তোমারা একেবারে চূর্নবিচূ্র্ন করে ফেলাছিল বাড়িটা । হামরা নিজে যায়া দেখে আসছি । মনে করেন যে বড় বড় গাছ যেগলা তিন পুরুষেও কাটে নি সেগলেক এক ধাক্কাত তিন চার মাইল নিয়া যায়া ফেলে দিছে । মানসের ঘরের টিনক উড়ে নিয়ে যায়া ফেলে দিছে আরেক এলাকাত । কত মানুস ঘরের টিন নিয়ে আসছে দূর-দূরান্ত থেকে । নিজের দেখা ঘটনা বাপু ,কি আর কমো । মানসের কাছে যায়া শুননো কি নাকি ত্যাজ সে বান্দরের খালি রাগোত শো-শো শব্দ করছে নাকি সে রাতোত । মানষের জান নিয়া টানাটানি । খিসটানের যে গিরজাটা আছিল ওটার তো নিশানা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি পরেরদিন । কি যে করছে ওটার । মসজিদগুলের কিন্তুক আবার কিছু হয়নি , পাকা মসজিদ আছিল তো সকগুলা । যাগের খেড়ের বাড়ি আছিল তারা তো বাড়িঘর ঊড়ে গেলে মসজিদেই আছিল । বিশ্বেস করেন নিজ চোকে দেখা , মসজিদগুলার এনা হলেও ক্ষতি হয়নি ।
- আল্লার ঘর হয় ক্ষতি হয় ক্যামনে । অনেকক্ষন পর অন্য বৃদ্ধ বলে ওঠে ।
- হ কতা তো সেট্যাই ।
- ক্যা একই রাতত পলাশগাছিতও তো একই ঘটনা ঘটছে ।
হ শুনছিলাম পলাশগাছির ঘটনা এনা এনা । ঝড়-বৃষ্টি হছিল নাকি খুব ।
-কিসের বৃষ্টি ! ক্ষেপে ওঠে গল্প বলা বৃদ্ধ । হাওয়া। হাওয়া চষে বেড়ে শ্যাষ করছে পলাশগাছি ।
হাওয়া কিসের হাওয়া ! সাবেত জানতে চায় ।
- হাওয়া বঝলে না বাপু । আমাবশ্যার আন্ধারের নাকান মিশমিশে কালো নাকিন একটা হাওয়া । তছনছ করে দিছে সককিছু । হামারহেরে এলাকার অনেকেই গেছিল দেখপার । মানসে যে পন্চাশ-একশ টেকা নিয়া গেছিল ওমাগের অবস্তা দেখে তাও দিয়ে আসছে ।
অপর বৃদ্ধও মাথা নাড়ে ।
- আল্লার খেল বুঝবার সাধ্য হামাহেরে কিইবা আছে ?
তাই দুনিয়ার মানুষ খোদার খেল কিইবা বুঝতে পারবে । মফেত ও সাবেতও সম্মতির মাথা নাড়ে ।

মফস্বল শহরটাতে কারেন্ট চলে এসেছে । ধানী জমির মধ্য দিয়ে আলোর রেখার আভাস দেখতে পায় মফা আর সাবেত । শহরের সবগুলো মসজিদ থেকে একযোগে এশার নামাজের আজান ভেসে আসে । ওদের এখন বাড়ি যেতে হবে । কারেন্ট আসার পর ওরা সাধারণত আর অপেক্ষা করে না । আজ ওদের আরেকটু থাকতে ইচ্ছা করে । বৃদ্ধদের সাথে গল্প করতে ইচ্ছা হয় আরেকটু । কিন্তু দুই বৃদ্ধ ইতিমধ্যেই বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে । থাকো বাপু হামরা গেনো নমাজ পড়া লাগবি । দুইবৃদ্ধ বাড়ির দিকে পা বাড়ায় । মফা আর সাবেতও আর বসে না ।
মফা আর সাবেত দুজনে মিলে পরদিন এর-ওর কাছে খোঁজ নেয় শেঙ্গলডাঙ্গা ও পলাশগাছী নিয়ে । হাল্কা একটা টনের্ডো হয়েছিল নাকি বছর খানেক আগে ঐ এলাকায় । মানুষের জানের তেমন ক্ষতি না হলেও মালের ক্ষতি হয়েছিল বেশ ,বিশেষ করে ঘরবাড়ি আর গাছপালার । মফা আর সাবেত এ বিষয়ে তেমন কিছু জানতে পারে নি কারন ঐ সময়টায় দুইবার ডিগ্রী ফেলের ব্যর্থতা ঢাকতে ওরা ঢাকা গিয়েছিল কাজ খুঁজতে এবং যথারীতি ব্যর্থ হয়ে একসাথে ফিরে এসেছিল তেরদিন পরে ।

মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই, ২০০৮

আমি বাংলাদেশ এখনও মরিনি - বেঁচে আছি

আমি বাংলাদেশ
আমাকে যারা তোমরা খুঁচিয়েছ,রক্তাক্ত করেছ
চোখ মেলে চেয়ে দেখ তারা আজ
এখনও আমি মরিনি
ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল অধিকার করে এখনো বেঁচে আছি
পলিসন্চন করে বাড়িয়ে তুলছি আমার অস্তিত্ব ।

আমার বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদীগুলো
একদা যাদের অস্তিস্তের সাথে মিশে থাকত নৌকা ও ইলিশ
এখন তাদের অধিকারে বিস্তীর্ণ বালুচর,কিম্ভুদরুপী বাঁধ
জেলেপাড়ার হারান মাঝি মাছ দেখেনা চোখে
বৃদ্ধ হারানের চোখে নদীগুলোর জন্য হাহাকার
মরে যাওয়া এসব প্রতিটি নদী
মৃত্যুর আগে বলে যাচ্ছে তোমরা হত্যাকারী
আমার নদীগুলোকে তোমরা হত্যা করছ
আমি বাংলাদেশ,আমাকে তোমরা হত্যা করছ।
মিলের গুদামে সারি সারি গাছের গুড়িগুলো
আসবাব ভেবে যাদের করেছ গুদামজাত
এদের বলতে দাও
এরা বলবে তোমরা হত্যাকারী
যুগ-যুগান্তরের আমার বৃক্ষেরা
আমার বুকে মাথা উচু করে দাড়ানো বৃক্ষেরা
এদেরকে তোমরা হত্যা করছ
আমি বাংলাদেশ,আমাকে তোমরা হত্যা করছ।
বায়ুতে আমার ভরছ বিষাক্ত সীসা
প্রবলভাবে শব্দাধিক্যর চর্চা করছ ডেসিবেলে
কর্ষিত জমির মধ্যে ভরে দিচ্ছ অ্যামোনিয়াম সালফেট
যেন ধমনীর মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছি পটাশিয়াম সায়ানেড
তবুও আমি বেচেঁ আছিএখনও না মরে বেচেঁ আছি।

আমি বাংলাদেশ বেঁচে থাকব
রক্তাক্ত,বিক্ষত আমি বেঁচে থাকব
আমার প্রতিটি শব্দ বেঁচে থাকবে যতদিন
আমার প্রতিটি বর্ণ বেঁচে থাকবে যতদিন
আটষট্টি হাজার সবুজ গ্রাম নিয়ে
মুখ থুবরে পড়ে থাকব ততদিন।

রবিবার, ২০ জুলাই, ২০০৮

যাপিতজীবন -০২ : : জমাট কলা কাহিনী

ছেলেবেলায় আমি কখনও জমাট কলা ( দুইটি কলা একসাথে থাকে ) খাই নি । আরও সহজভাবে বলতে গেলে জমাট কলা কখনও পাইনি যে খাব । আমাদের বাসায় আব্বা কখনও জমাট কলা আনতেন না । বাসায় সবাই জানত কোন পুরুষমানুষ জমাট কলা খেলে তার বৌ এর জমজ বাচ্চা হয় ! এক বাচ্চার দুনিয়ায় আসা আর তার বেড়ে ওঠা নিয়েই যত সমস্যা দুইটা বাচ্চার রিস্ক নেয় কোন বোকা ? তাই বাসায় পাওয়া এ শিক্ষাটা আমি অনেকদিন মেনে চলেছি । পরিচিত অনেক বন্ধু ও মানুষকেই পরবর্তিতে দেখেছি তারাও এ ঝুঁকি নিয়ে জমাট
কলা খান না । সুতরাং এই বিষয়টা নিয়ে কোথাও তেমন কোন বিড়ম্বনার মধ্যে আমাকে পড়তে হয়নি , মুখোমুখি হতে হয়নি বন্ধু-বান্ধবের টিটকারীরও ।

জমাট কলা না খেয়ে ,বৌয়ের ডাবল কাচ্চা-বাচ্চার ঝুঁকি এড়িয়ে দিন আমার ভালই যাচ্ছিল কিন্তু বিধাতার বুঝি আর সহ্য হল না । আঠারো বছর বয়সে যখন সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বান্ধবি( পড়ুন প্রেমিকা ) জোটানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ল তখন ঐ বয়সে আমার মধ্যে তীব্র বৈরাগ্যবোধ জন্ম নিল । এই অধমের মনে হল এই জীবন আর সংসার সব ঝুটা হ্যায় । কি লাভ এতে ? সিদ্ধান্ত নিলাম সারাটা জীবন অকৃতদারই থেকে যাব (এখন অবশ্য মাথা থেকে ভূতটা নামছে , মনে হচ্ছে বিয়াটা জরুরীই!)। বিয়েই যখন আর করছি না তাই বৌ বা কাচ্চা-বাচ্চা কিছুই আর হচ্ছে না । সুতরাং ডাবল বাচ্চার রিস্ক থাকা সত্ত্বেও জমাট কলা আমার জন্য হালাল হল । কিন্তু অন্য সকল ভাইরা যারা বিয়ে করেছিলেন বা বিয়ে করার মনস্ত করেছিলেন তাদের জন্য এই প্রজাতির কলা তখনও হারাম(!) ছিল । বলা বাহুল্য তার সুফল সেই সময় থেকে আমি পেতে শুরু করেছিলাম এবং এখনও পাচ্ছি । কিভাবে ? সেই হিসাবটাই আমি এখন বলব ।

একবার টার্ম ফাইনাল পরীক্ষার পর হলে খাবার-দাবারের প্রার্দুভাব দেখা দেয় । পর্যাপ্ত ছাত্র নাই এই হেতু প্রায় সব হলের (একটি বাদে ) ক্যান্টিন বন্ধ করে দেয়া হয় । আহার গ্রহনের নিমিত্তে জৈষ্ঠ মাসের তালপাকা দুপুরে দূরবর্তী হলের ক্যান্টিনে নির্দিষ্ট সময়ে যেতে হয় । সময়ের একটু এদিক ওদিক হলেই সারা ! গিয়ে কতগুলো টেবিলে ছাত্রদের চাবানো মুরগীর হাড় ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না । সুতরাং সময় নিয়ে সবসময় তৎপর থাকি । কিন্তু বন্ধের মাসে কতই বা আর ঘড়ি ধরে চলা যায় ? দুপুরের প্রবল ঘুমের তোড়ে একবার ক্যান্টিনের টাইম মিস হয়ে যায় । অগত্যা ক্ষুধায় কাতর আমি যাই পলাশী বাজারে রুটি আর কলা কিনতে । তখন দ্রব্যমূল্যর উদ্ধগতিতে প্রতি পিস কলার দাম সবে দুই টাকা থেকে তিন টাকা হয়েছে । এমনিতেই সারা মাস বাহিরে বাহিরে খেয়ে পকেটের অবস্থা টাইট তারপরে দোকানীও দেখি বা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির সমান কলা তিন টাকা করে চায় প্রতিটা । মেজাজ অত্যধিক খারাপ । জমাট দুইটা কলা দেখিয়ে দোকানীকে বলি আলাদা দুইটার ঝামেলা না করে ঐ দুইটাই দিন । দোকানীকে দশ টাকার একটা নোট দেই। দোকানী আমাকে সাত টাকা ফেরত দেয় । আমি লোকটার কান্ডজ্ঞান দেখে অবাক হই । এরে দিয়ে ব্যবসা হচ্ছে কিভাবে ? দোকানীকে বলি আমি তো দুইটা নিছি আপনি একটার দাম রাখছেন । দোকানীও মনে হয় আমার কান্ডজ্ঞান দেখে অবাক হয় । বলে জমজ কলার দাম একটার দামের সমান । দোকানীর ভাবটা এমন এই সাধারণ জিনিসটা আমি এতদিন জানতাম না ! আমি যুগপৎ অবাক আর আনন্দিত হই । এই চরম দুর্দিনে একটার দামে দুইটা কলা ( হোকনা জমজ) পাওয়া যাচ্ছে এটা কি কম আনন্দের ! আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ঐ দোকানেই শুধু মনে হয় এই হিসাব কিন্তু পরে অন্য দোকানেও দেখেছি একই অবস্থা । আমি সেই থেকে কলার দোকানে গেলে জমাট কলা খুঁজি । একটা কলার দামে যখন দুটি পাওয়া যাচ্ছে সেখানে আলাদা করে দুটি কিনে দোকানীকে বেশী টাকা দিয়ে কি লাভ !

সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০০৮

যাপিতজীবন -০১ : : পরিচয় সংকট

লোকগুলোর সাথে আমাদের দেখা হয় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার সূরা মসজিদে । তিনজন লোক , সবাই মধ্যবয়স্ক । মসজিদের সামনের বিশাল তেঁতুল গাছের নিচে বসে হয়ত বাতাস খাচ্ছিলেন তারা ।

আমরা গিয়েছি মসজিদটা দেখতে । অনেক পুরানো ঐতিহাসিক মসজিদ যেটা ঠিক কখন তৈরী হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না । স্থানীয়দের সাথে এ মসজিদটা নিয়ে একটু কথা বলতে ইচ্ছে হল আমাদের । লোকগুলোকে দেখে আমাদের ভালই লাগল যাক বেশ হল আমারাও ওনাদের সাথে তেঁতুল গাছের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নেই আর গল্প করি । আমিই প্রথম কথা বলতে শুরু করি তাদের সাথে-আপনারা কি এই গ্রামেরই ।
-হ্যাঁ , এখানকারই ।
ঐ পাশে বাড়ী ।একটা লোক ইশারা করে সবুজ ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ওনাদের বাড়ি দেখিয়ে দেয় আমাদের । আমি একজনের হাতে একটা নাইলনের ব্যাগ দেখি ভিতরের কি জানি কুঁ-কুঁ আওয়াজ করছে । কৌতুহল হয় ভিতরে কি আছে জানার । আমি আবার জিজ্ঞাসা করি
-ব্যাগের ভিতরে কি ?
লোকগুলোর মধ্যে একটা কেমন যেন অস্বস্থিভাব দেখতে পাই । একজন মৃদুকন্ঠে জবাব দেয়-ইঁদুর
বুঝতে বাকি থাকে না লোকগুলো সাঁওতাল আর এরা এগুলো খাওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে । তারপরও জিজ্ঞাসা করি
-এগুলো তো খাবেন তাই না ?
লোকগুলোর মধ্য অস্বস্থিভাবটা আরো প্রকট হয়ে ওঠে যদিও আমার জিজ্ঞাসা করার মধ্যে কোন অস্বাভাবিকতা ছিল না ।
-হ্যাঁ , খাব । আমরা আদিবাসি ।
মুখ শুকনো করে বলে একজন । তাদের মুখ থেকে আমরা তাদের আসল পরিচয়টা পাই কিন্তু পুরোটা পাইনা । তারা হয়ত এটা বুঝতে শিখেছে সাঁওতাল বলার চেয়ে আদিবাসী বলাটা আমাদের মত ভদ্র পোশাক-আশাক পরা লোকের কাছে অনেকটা শোভন । আমি জিনিসটা আরেকটু নাড়াতে চাই
- সাঁওতাল তাই না ?
-হ্যাঁ ।
লোকগুলোর মুখ আরো শুকনো হয়ে ওঠে । একজন আবার বলে এখন সাঁওতাল আর অন্য সমাজের (পড়ুন হিন্দু বা মুসলমান সমাজ) মানুষের মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই , সবাই ক্ষেত-খামারের কাজ করছে একসাথে , আগের মত বন-জঙ্গলও নেই শিকার-টিকারও নেই । আমাদের মত ভদ্রস্থ শার্ট-প্যান্ট পড়ে আসলে নাকি আমরা তাদের চিনতেই পারব না তারা সাঁওতাল আরেকজন বলে ।

লোকগুলো তাদের গা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাঁওতাল গন্ধ মুছে ফেলতে চায় , যত তাড়াতাড়ি পারে মিশে যেতে চায় সাধারণের মাঝে যাতে তাদের হঠাৎ করে সাঁওতাল বলে তাদের আলাদা করা না যায় । সাঁওতালদের একটা নিজস্ব কৃষ্টি আছে , কালচার আছে । কি এমন কারন যার জন্য একটি সম্প্রদায়কে তাদের পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করতে হয় , প্রজন্মকে ভুগতে হয় আত্বপরিচয় বিষয়ক সংকটে ? আমরাও কি এর বাহিরে আছি ?

রবিবার, ২৯ জুন, ২০০৮

সেইসব পাখিরা আর পাখিদের মত ঘুরে বেড়ানো মানুষেরা

অজস্র মাইল ঘুরে আসে সেইসব পাখিরা
অস্থিতে কনকনে শীতের গন্ধ ,সামান্য উষ্ণতার আশা
সাইবেরিয়ার অরন্য দু চোখে বয়ে নিয়ে
এইসব ধানের দেশে আসে সেইসব পাখিরা -
কোন শীতের সকালে বিলের পানিতে পা ডুবিয়ে উষ্ণতা খোঁজে
ঘোলে চোখে দেখে যায় মৃদু বৃষ্টির মত নেমে আসা কুয়াশার ধারা
বুকের মধ্য অনবরত বেজে যায় সুদূর সাইবেবিয়া
রাত্রের নিকষ অন্ধকারে চোখ বুজে আসলে স্বপ্ন ভেসে ওঠে
সাইবেরিয়ার স্বপ্ন , মাতৃভূমিতে ফিরে যাবার স্বপ্ন।

শীতের এইসব পাখিদের মতই যেন আমরা
উষ্ণতার খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছি এদেশ-সেদেশ
প্রশান্ত থেকে আটলান্টিক , বাল্টিক আর টেমস
অজস্র এই আমরা
ঠিক যেন পাখিদের মত -
চোখে স্বপ্ন , দেশে ফেরার স্বপ্ন ।
সেইসব পাখিদের মত আমরাও হয়ত কেউ কেউ ফিরে যাই
অথবা আমাদের কেউ কেউ পড়ে থাকি , মরার মত পড়ে থাকি
প্রবাসের ভাগাড়ে , যেমন করে যেইসব পাখিরা পড়ে থাকে
বালুচরে , শিকারীর এয়ারগানে বিদ্ধ হয়ে ।

রবিবার, ২৫ মে, ২০০৮

একটি খুনের স্বপ্ন : : অনেকদিন আগে পড়া একটি বই নিয়ে গল্প

সেদিন একজনের সাথে কথা হল । তিনি আমাকে বললেন গল্প -উপন্যাসের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই । সবই নাকি ফ্যান্টাসি লাগে । পড়তে ধরলেই নাকি মনে হয় এসবের কিছুই কখনো বাস্তবে হয় নি , বিশ্বাস করার কোন কারন নেই । গল্প নিছক গল্পই । আর আগ্রহ পান না পড়ার । এসব আর কি?

পরে আমি ওনার কথাগুলো নিয়ে ভাবতে থাকি । আসলেই কি এগুলো ফ্যান্টাসি ? বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে কি অত্যধিক মাত্রায় অনুভূতিপ্রবণও নয় । এরকম ভাবতে পারলে হয়ত সামান্য কিছু লাভ হতে পারত , অন্তত আমার ক্ষেত্রে । কিছু কিছু বই পড়ে যন্ত্রনাও পেতে হয় । যন্ত্রনাটা প্রখর হয়ে ওঠে যখন সেটা সাময়িক মানে দু -এক ঘন্টা না স্থায়ী না হয়ে কয়েকদিনব্যাপি স্থায়ী হয় । আজকে আমি সেরকম একটা বই পড়া বিষয়ক যন্ত্রনার কথাই বলব।

আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি । হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে চারিদিকে প্রচুর হইচই হচ্ছে । আমিও এই হইচইয়ে যোগ দেই । নীলক্ষেত থেকে আজাদের যত বই আছে একে একে কিনে পড়ে ফেলতে থাকি । ওনার কবিতাগুলো ভাল লাগতে থাকে , মুগ্ধ পাঠক হয়ে উঠতে থাকি ওনার কবিতার । কিন্তু উপন্যাস যে দু একটা পড়ি (শ্রাবনের বৃষ্টিতে রক্তজবা , ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ ) এগুলোকে একঘেয়ে মনে হয় । কেমন জানি উপমার বাহুল্যতা আর গায়ে পড়ে অশ্লীল কথাবার্তা শোনানোর মত মনে হয় উপন্যাসগুলো । কিছুতেই টানতে পারে না উপন্যাসগুলো ।

আজাদের উপন্যাস কিনবনা কিনবনা করেও একদিন আরেকটি কিনে ফেলি ," একটি খুনের স্বপ্ন" । একশো বিশ বাইশ পৃষ্ঠার ছোট একটি বই , ভালমত পড়তে তিন -চার ঘন্টার বেশী লাগার কথা না । উপন্যাসের ঘটনা তারচেয়েও সামান্য । সহজভাবে বলতে গেলে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের প্রেম কাহিনীর বর্ণনা । কিন্তু আজাদের হাতে এই সামান্য কাহিনীই অসামান্য হতে শুরু করে । প্রেমিকা সুফিয়ার জন্য নায়কের অনূভূতি , তাকে পাওয়ার আকুলতা সর্বোপরি নায়কের স্বাভাবিক জীবনযাপনে প্রেমিকার উপস্থিতি এবং তৎসংলগ্ন প্রভাবের বর্ণনা পড়ে আমি মুগ্ধ হতে থাকি । অনবরত বলতে থাকা উপমাগুলোকে আর অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না ।

বইয়ের অর্ধেক অংশজুড়ে এই রোমান্টিসিজমের পর ঘটনা একটু অন্যদিকে মোড় নেয়া শুরু করে । স্বাভাবিক পাঠকমাত্রই বুঝতে পারছেন বিচ্ছেদ হবে আরকি ? কিন্তু আজাদ এই বিচ্ছেদের বর্ণনাটা দেন একটু অন্যভাবে ।
তোফাজ্জল নামক এক কথিত ভাইয়ের সাথে নায়ক পরিচয় করিয়ে দেয় প্রেমিকার । ধীরে ধীরে তোফাজ্জল চর্তুপাশ ঘিরে উঠতে থাকে সুফিয়ার । নায়কের অজান্তে যায় সুফিয়ার বাসায় , নানান ধরনের উপহার দিতে থাকে সময়ে অসময়ে । তোফাজ্জল আর সুফিয়ার মধ্যে গড়ে উঠতে থাকে আরেকটি সম্পর্ক । নায়কের বুঝতে প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও একদিন সে সরাসরি বুঝতে পারে । বুঝতে পারে একদিন সকালে তোফাজ্জলের বাসায় । আজাদের বর্ণনা অনুযায়ী
উদ্ধৃতি
আমি নিঃশব্দে ভিতরে ঢুকে প্রথমে অন্ধ হয়ে যাই , তারপর আমার চোখে আলো জ্বলে ওঠে , অন্ধকার থেকেও যা উজ্জ্বল , মহাবিশ্ব ভেঙে পড়ার পর দেখা যাবে যে -আলো ,আমি তাদের কাছে এগিয়ে যাই ; বিকট সিল মাছের মত কালো নগ্ন তোফাজ্জল ভাইয়ের আবর্জনাস্তূপের মতো দেহের ওপর একটি পা রেখে নগ্ন সুফিয়া ঘুমিয়ে আছে , সিলটি পড়ে আছে লাশের মত সুফিয়ার মুখটি পূর্ণিমার চাঁদের মতো জ্বলছে , সরস্বতী ও অসুর জড়িয়ে আছে একে অন্যকে , দুজনেই গভীর ঘুমে নিমজ্জিত , হয়ত একাধিক সঙ্গমের তারা ক্লান্ত সুখনিদ্রায় লুপ্ত হয়ে আছে , জেগে উঠে আবার সঙ্গম করবে পশু ও সুন্দরী ।

এরপর নায়ক একটি খুনের স্বপ্ন দেখা শুরু করে , যা সে দেখতে পায় স্বপ্নে । প্রথমে সে বিব্রত বোধ করা শুরু করে ভয়ও পায় খানিকটা কিন্তু পরে সে এটাকে একটা অর্পিত দায়িত্ব ভাবা শুরু করে যেন অবশ্যই পালন করতে হবে । নায়কের মাথায় একটি স্বপ্ন জেগে থাকে - একটি খুনের স্বপ্ন ।

আমি উপন্যাসটি পড়া শেষ করি । আমার প্রচন্ড আক্রোশ তৈরী হতে শুরু করে তোফাজ্জলের উপর , সুফিয়ার উপর। কিছুই ভাল লাগে না । আমি বারবার নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি আরে এটাতো সামান্য একটা উপন্যাসই , লেখকের মনে হয়েছে লেখক লিখেছে । কিন্তু সান্ত্বনায় কোন কাজ হয়না । আমি বারবার ভুলে যেতে থাকি এটা একটা উপন্যাস । আমার মনে হতে থাকে নায়কের চরিত্রে আমি দাড়িয়ে আছি । নগ্ন সুফিয়া সামগ্রিক ঐশ্বরিক সৌন্দর্য নিয়ে বাহুবন্ধনে পড়ে আছে তোফাজ্জলের । আমার রাগ বাড়তে থাকে । রাগ বাড়তে থাকে তোফাজ্জলের উপর , রাগ বাড়তে থাকে সুফিয়ার উপরও । আমি পলাশী বাজারে যাই , চা খাই । সেসময় সিগারেট খেতাম না কিন্তু সিগারেটও ধরাই একটা । একটা যন্ত্রনা আমার মাথার মধ্যে কাজ করে । আমি যন্ত্রনাটাকে সরাতে চেষ্টা করি কিন্তু এটা মাথার মধ্যে গেড়ে থাকে আরো দু তিনদিন । অজান্তে আমিও একটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করি , নিতান্ত ছেলেমানুষি স্বপ্ন - একটি খুনের স্বপ্ন ।(এটা লেখাটা নিতান্ত মাত্রাতিরিক্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয় , পাঠকদের বলে নিলাম । বই পড়ার মধ্যে যে একটা যন্ত্রনা আছে সেটা সেই কয়েকদিন বুঝেছিলাম )

শুক্রবার, ২ মে, ২০০৮

দূরত্ব

রাতুলের বাবার কথা :

রাতুল ওর একটা নিজস্ব জগত তৈরি করে নিয়েছে । এখানে খুব একটা লোকজন নেই , আমি আর ওর মা তো মনে হয় নেইই । রাতুল আমাদের মন খুলে কিছু বলে না । আমরা যে কোন কিছু সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে হা-না বলে চালিয়ে নেয় , পারতপক্ষে কথা বলতেই যেন ওর আপত্তি । রাতুলের ব্যাপারে কোন কিছু জানার দরকার হলে প্রথমে আমি ওর মার কাছে জানতে চাই । আমার মনে হয় মার কাছে হয়ত এ বিষয়ে ও বলবে কিন্তু খুবই হতাশ হই যখন জানতে পারি ওর মা ও এ বিষয়ে কিছু জানে না ।আমি বুঝতে পারি ওর সাথে একটা দূরত্ব তৈরী হয়েছে। দূরত্ব সৃষ্টির ব্যাপারটা এমন যেটা একবার তৈরী হয়ে গেলে সহজে ভাঙা যায়না ,বিশেষত ও যখন আঠারো বছরের তরুন , কলেজে পড়ে । মাঝে মাঝে আমি রাতুলের সাথে আমাদের এই দূরত্ব সৃষ্টির ব্যাপারটা নিয়ে ভাবি , খুঁজে বের করার চেষ্টা করি কোথা থেকে এই দূরত্বটা সৃষ্টি হল । ওর মাকেও বলি বিষয়টা । সে বলে না কোথায় দূরত্ব তৈরী হয়েছে , ঠিকই তো আছে সবকিছু । কিন্তু আমি জানি এটা ওর মনের কথা না , মায়েরা কখনোই মনে করেনা সন্তান একটু দূরে সরে গেছে । আমার মনে হয় দূরত্ব সৃষ্টির এই ব্যাপারটা তৈরী হয়েছে ওকে কম সময় দেয়াকে কেন্দ্র করেই । আমরা স্বামী -স্ত্রী দুজনেই সরকারী চাকুরী করি , নয়টা পাঁচটা অফিস সেরে ওকে সেভাবে সময় দেয়া হয়নি। এসময়টা ও হয়ত স্কুলে গিয়েছে অথবা একা একা বাসায় থেকেছে । অফিস থেকে একটু শহরে ঘুরে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যখন দেখতাম ও অসময়ে টিভি দেখছে তখন আমার মেজাজ একটু খারাপ হত । ও হয়ত ব্যাপারটা বুঝতে পারত । আমি আসলেই টিভি বন্ধ করে পড়ার টেবিলে চলে যেত । পড়ালেখায় বরাবরই ভালো থাকার কারনে আমি কিছু বলতাম না । আমার সাথে বরাবরই ওর কথা হত কম । ও মূলত আমার সাথে কথা বলত টাকার ব্যাপারে । শুধুমাত্র স্কুলের বেতন বা ব্যাচে প্রাইভেট পড়ার জন্য টাকার দরকার হলে আমার কাছে টাকা চাইত , হাত খরচের টাকা পর্যন্ত চাইত না । ক্লাস ফাইভে এইটে বৃত্তি পেয়েছিলো । ওই টাকা দিয়েই হাতখরচ চালাত মনে হয় । এখন আমার মনে হয় কিছু কিছু জিনিস ভুল হয়ে গেছে । ওকে পুরোপুরি ওর মত থাকতে না দিয়ে সময়ে অসময়ে একটু কথা বলা উচিত ছিল আমার । হয়ত ও যখন টিভি দেখছিল তখন গিয়ে এর পড়ালেখার খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল , স্কুলের কোন স্যার কেমন , সামনে ওর জন্মদিনে বন্ধুবান্ধবদের ও বাসায় দাওয়াত দিতে চায় কিনা এসব হাল্কা বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল । মফস্বল শহরে ছেলেদের দল বেঁধে খেলাধুলা করতে দেখি বিকেলে । রাতুল ওসবে গিয়েছেও খুব কম । অবশ্য আমারও এখানে একটা দোষ ছিল আমিই যেতে দেইনি। কত খারাপ ছেলেই তো আছে কার সাথে মিশে কখন কোন পথে যায় । এখন বুঝতে পারি ব্যাপারটা খুব একটা ভাল হয়নি । ওর বয়সের ছেলেদের সাথে ওর মেশা উচিত ছিল , ভালোভাবেই মেশা উচিত ছিল । এতে হয়ত আমাদের সাথে ওর কথাবলার জড়তাটুকু কেটে যেত ।

\

রাতুলের মার কথা :
রাতুলের বাবা মাঝে মাঝে আমার কাছে রাতুলের নানান বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করে । আমি উত্তর দিতে পারিনা । ওর সাথে আমার কথাই হয় কম । বাসায় থাকলে হয় ও পড়াশুনা করে নাহয় টিভি দেখে । অফিসের অনেকের কাছে শুনি তাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করতে চায় না , নানান বায়ানাক্কা করে । কিন্তু রাতুলকে কখনও পড়াশুনার কথা বলতে হয়নি । হাইস্কুলে থাকার সময়েও ও খাওয়া , ঘুম , স্কুল , স্যারদের কাছে ব্যাচে পড়তে যাওয়া খুবই নিয়মমত প্রায় রুটিনমাফিক করত । আমি আশ্চর্য হতাম এত কম বয়স থেকে এই ছেলে এরকম নিয়মকানুন শিখল কোথা থেকে । আমারও ওর এ বিষয়গুলো ভাল লাগত , তাই আমিও ওকে ওর মত থাকতে দিতাম । রাতুলের বাবা মাঝে মাঝে বলে ওর সাথে নাকি আমাদের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে । আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারি কিন্তু হেসে উড়িয়ে দেই , আমিও সায় দিলে লোকটা হয়ত মনে মনে কষ্ট পাবে । যদিও আমিও জানি রাতুলের সাথে আমাদের আসলেই একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে ।

রাতুলের কথা:
কলেজে অনেকে আমাকে মেশিনম্যান নামে ডাকে । একবার আমি একজনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম মেশিনম্যান কি ? সে হেসে জবাব দিয়েছিল যন্ত্রমানব । আমি বুঝতে পারিনি কেন ওরা আমাকে এ নামে ডাকে । অনেকদিন পর একজন আমাকে বলেছিল আমি নাকি যন্ত্রের মত রুটিনমাফিক সবকিছু করি । নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাসে আসি , নির্দিষ্ট সময়ে কলেজ থেকে ফিরি ,যন্ত্রের মত স্যারদের লেকচার তুলি পাশের ছাত্রের সাথে কোন কথা না বলেই, অন্যদের সাথে কথাও বলি মেপে মেপে প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া বলতে চাই না । ওরা হয়ত ঠিকই বলে , নির্দিষ্ট একটা রুটিনের বাহিরে কেমন যেন এলোমেলো লাগে আমার । আগে মফস্বলে বাসায় থাকতেও এটা করতাম এখন ঢাকায় কলেজে পড়তে এসেও এটা করি । বাসায় থাকতে আম্মা পছন্দ করতেন এটা । পাশের বাসাতে গিয়ে গল্প করতেন আমাকে নিয়ে , রাতুল তো পুরো রুটিনমাফিক চলে , রুটিনের বাহিরে একপা ও যেতে চায় না । বাসায় আমার তেমন কিছু করার ছিল না । অনেকের বাসায় ভাইবোন থাকে একসাথে সবাই মিলে হল্লা করতে পারে কিন্তু আমাদের বাসায় দিনের বেলায় বলতে গেলে লোক থাকত দুইজন । একজন আমি আর একজন কাজের বুয়া । বুয়ারা অধিকাংশই থাকত দেশ থেকে আনা স্বামী পরিত্যক্তা বয়স্কা মহিলা । এরা বাসায় থাকার পরিবর্তে হাতের কাজ সেরে পাশের বাড়ীতে গিয়ে গল্পগুজবেই ব্যস্ত থাকত । ফলে অধিকাংশ সময়েই খালি বাসায় একলা থাকতে হত আমার । স্কুলে গিয়ে আমি শুনতাম ক্লাসের ছেলেরা নানান বিষয়ে আলাপ করত । সরকারী কলেজে একটা বড় পুকুর ছিল ওখানে ভরদুপুরে সাতরাত ওরা , বিভিন্ন এলাকায় দল বেঁধে ক্রিকেট খেলতে যেত , অখিলবাবুর বড় আমবাগানে চুরি করে খেত লিচু, নারকেল ,আম ইত্যাদি । আমি ওদের কখনো যেতাম না , বলা যেতে পারে যেতে ভয় পেতাম যদি আব্বা জানতে পারে। একবার ক্লাস সিক্সে থাকতে আমি কলেজের বড় মাঠটাতে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলাম বাসার কাজের বুয়াকে না বলে । আব্বা কি জানি কাজে অফিস থেকে বাসায় এসে আমাকে না পেয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন মাঠে । বাসায় ফিরে রান্নাকরার একটা কন্চি দিয়ে মেরেছিলেন খুব । বাসায় আম্মা ছিলেন না । আমাকে উদ্ধার করতে কেউ আসেনি সেদিন। আমার সাথে সেদিন যারা মাঠে খেলছিল ওরা আমাকে আব্বা মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন দেখে খুব অবাক হয়েছিল , সম্ভবত ভয়ও পেয়েছিলো একটু । আমাকে আর কখনও খেলতে ডাকেনি ওরা। সেই থেকে আব্বাকে আমি প্রচন্ড রকম ভয় পাই । পারতপক্ষে পরতে চাইনা আব্বার সামনে । আব্বাও দেখি আমার সাথে কথা বলেন কম । অন্য বাবারা দেখতাম আমার বাবার থেকে আলাদা । ঈদের নামাজে ছেলেদের একসাথে নিয়ে যান , মেলা টেলায়ও নিয়ে যান নিয়ম করে । অথচ আমি ঈদের নামাজে যেতাম পাশের বাসার বদরুল ভাইয়ের সাথে , মেলার সময় আমার হাতে বাবা গুজে দিতেন বিশ টাকার একটা নোট । আমি ভাবতাম বাবা এমন কেন ? কিন্তু আমার বোধ একদিন পাল্টে । ঢাকায় পড়তে আসার সময় আব্বা আমার সামনে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন । আমি অবাক হয়ে যাই , এতটা ভালবাসা আব্বা কোথায় রেখেছিলেন এতদিন । মানুষ কতভাবে নিজেকে খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলে ভাবতে থাকি আমি । ছুটিছাটায় বাড়িতে গেলে সবাই নাকি আব্বা-আম্মা -ভাইবোনের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেয় । ঢাকায় এসে গল্প করে মেসে । আমি পারিনা ওদের গল্পে অংশগ্রহন করতে। বাসায় গেলে আব্বা আমাকে কিছু গতানুগতিক প্রশ্ন করেন আমিও হা-না করে উত্তর দিতে থাকি । আমি জানি আমার সাথে পিতামাতার একটা দূরত্ব আছে , আমি ভাঙতে চেষ্টা করি দূরত্বটা , পারি না।

সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০০৮

একটি অসমাধাকৃত ছিনতাই (বাস্তব)

২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা।

পলাশী থেকে যাত্রা শুরু করলাম । উদ্দেশ্য মধুবাগ ,এক ছাত্রীকে পড়াতে যেতে হবে । কোন রিকশা নাই । পলাশীতে অনেক সময় রিকশা পাওয়া যায়না , ভাবলাম একটু হাঁটি নীলক্ষেত পর্যন্ত যাই। নীলক্ষেতেও দেখি কোন রিকশা নাই । কি মসিবত। হেঁটে আবারও শাহবাগ পর্যন্ত এলাম ,দেখি ওখানে কি অবস্থা । তখন সদ্য মফস্বল শহর থেকে এসেছি , হাঁটাহাটি কোন বিষয় ছিলনা। শাহবাগে এসে শুনলাম রিকশা ধর্মঘট , সারা শহরে রিকসা চলাচল বন্ধ । কি বিপদ , এখন কেমনে যাই। একবার ভাবলাম হলে ফিরে যাই এতদূর কষ্ট করে যাই কিভাবে । পরে ভাবলাম শাহবাগ পর্যন্ত যখন এসেছিই দেখি হেঁটেই যাই আজকে , পায়ের যা হবার হবে । যা ভাবা তাই কাজ । শাহবাগ থেকে রমনা ,শিল্পকলা একাডেমি, কাকরাইল হয়ে পৌছালাম কর্নফুলী গার্ডেন সিটির সামনে । তখনই ভদ্রলোকটির(!) সাথে আমার দেখা । আমি দ্রুত সামনে যাচ্ছি উনি ডাকলেন এই যে ভাই ।আমি পিছনে ফিরে চাই।
-পায়ে লাগল সরি বললেন না।
আমি ভাবলাম কি ব্যাপার পায়ে লাগল কখন ? আচ্ছা ভুল করে লাগতে পারে ,দ্রুত হাটছিলাম । আমি বলি
-ও পায়ে লেগেছে নাকি ! সরি আসলে আমি খেয়াল করি নাই।
ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে আসেন । হাতে হাত মেলান।
-আপানার নাম।
-কায়েস।
-কৈ যাবেন।
-মধুবাগ যাব।
-থাকেন কৈ ,কি করেন।
-পলাশী থাকি। বুয়েটে পড়ি ,ওখানে হলে থাকি।
-ও আচ্ছা । আপনার মোবাইলটা একটু দেবেন । একটা জরুরী কল করা লাগত ।

আমি ভাবি ভদ্রলোক যখন বিপদে পড়েছেন দেই মোবাইলটা। তাছাড়া তখনও সদ্য মফস্বল আগত আমি জানতাম না এই শহরে মানুষ রাস্তাঘাটে কত ফিকির নিয়ে ঘোরে। আমি মোবাইলটা এগিয়ে দেই। লোকটি মোবাইল নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে । আমার সন্দেহ হয় । অবচেতন মন থেকে কে যেন বলে মোবাইলটা নাও ,এই লোকের উদ্দেশ্য ভাল না। ওসময় মাথা ঠিক ছিলনা । আমি তাই যা-তা বলি ,ভাই একটা নাম্বার আছে দেন ওটা ডিলিট করেই আপনাকে দিচ্ছি। লোকটা প্রথমে একটু ইতস্তত করে । আমি আরেকটু জোর করলে উনি দিয়ে দেন । আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকি । উনি বলেন মোবাইল দেন । আমি বলি না ভাই মোবাইল দেয়া যাবেনা। এবার পাশ থেকে আরেকজন লোক আসে । লোকটা বলে-
-আমাদের ভাই মোবাইল চাইছে আর তুই দিলি না । এনারে চিনস । সেভেন মার্ডার বিপু বললে এনারে সবাই চেনে । মোবাইলটা দে ।লোকটা আমার হাতটা সেভেন মার্ডারের কোমড়ে ধরে । ওখানে পিস্তল টাইপ একটা জিনিস অনুভব করি। কিন্তু আমিও তখন মফস্বলের গোঁড়ার তরুন। এত লোকের মাঝে মোবাইল নিবা , এত সোজা , দেখি কি কর তোমরা ।সেভেন মার্ডার এবার ভাষার ভদ্রতা হারান।
-তোরে এখানে কেউ মাইরা রাখলে কেউ দেখব । চিল্লাবি চিল্লা দেখি। দেখ কেউ আসে কিনা । এই এরে ধর নিয়ে যাই চিপায়। শালার হাত পা আজকে ভেঙে দেওয়া লাগবে ।ঐ সময়ে ১৮ বছরের একজন তরুনকে ভয় দেখানোর জন্য এটা যথেষ্ট ছিল (এখন হলে তো সরাসরি দিয়েই দেব!)। কিন্তু কেন জানি ঐ সময়ে আমি গোয়ার্তুমির চূড়ান্ত করি।
-না মোবাইল দেওয়া যাবেনা।
লোকটা কিছুক্ষন আমাকে দেখে । ওনার চোখে আমি অবিশ্বাস দেখি। এরকম ঘটনায় মনে হয় আর কখনো পড়েনি আগে। কি করবে বুঝে উঠতে কিছুক্ষন সময় লাগে তার।
-দিবিনা। আচ্ছা যা । আর য্যান তোরে দেখিনা এ এলাকায়।

আমি বিদাই হই । ছাত্রীকে গিয়ে বলি আগে এক গ্লাস পানি নিয়ে আস।এরপর আমি কয়েকজনকে ঘটনাটা বলেছি। অনেকে বিশ্বাস করেছে , অনেক ভেবেছে চাপা মারছি । কেউ বলেছে এত সাহস তোমার , ঘুমাও ক্যামনে রাতে।
আমি কিছু বলিনি। মুচকি হেসেছি।

রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০০৮

দুটি পরমানু গল্প

১। ক্যালিফোর্নিয়ার অগ্নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা দাবানলে পুড়ে যাওয়া বনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ করতে একাংশে আংশিক পোড়া মৃতদেহ দেখতে পায় । মৃত লোকটি ছিল ভেজা সাঁতারের পোষাক ,ফ্লিপার (সাঁতার কাটার জন্য তাড়নীবিশেষ) আর মুখোশ পরিহিত । পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টে বলা হয় লোকটি আগুনে পুড়ে মারা যায়নি বরং মারা গেছে অভ্যন্তরীণ জখমের কারনে । তদন্তকারীরা তদন্ত করে উদঘাটন করেন আসল তথ্য।
দুর্ঘটনার দিন লোকটি বন থেকে মাইলবিশেক দূরে সাগরে যায় সারফিং করতে । দমকল বাহিনীর লোকজন যত দ্রুত সম্ভবআগুন নেভানোর জন্য বিশাল বিশাল বাকেটওয়ালা (বড় বালতি জাতীয়) হেলিকপ্টার ব্যবহার করে । বাকেটগুলো দ্রুত ভরার জন্য সমুদ্রে ফেলা হয় এরপর বনে খালি করা হয় পানি ফেলে । বেচারা লোকের ভাগ্য এমন তার আশ্রয় হয় এমনই একটা বাকেটে । বেচারা!

২। আয়ারল্যান্ডের লোকেরা কৃপণ বলে বেশ খ্যাত । এমনি একজন ভাবি আইরিশ দম্পতির মধ্য কথোপকথন ।
স্ত্রী : তোমার মত কৃপণ লোককে বিয়ে করব না । এই নাও তোমার বাগদানের আংটি ।
পুং: আংটি না হয় দিলে কিন্তু আংটির কেসটা কোথায় । (শেষ)

শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০০৮

ধরা

মেয়েটাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে , এমন রিনরিন করে কথা বলে যেন মনে হয় কোথাও হাল্কা স্বরে বাশিঁ বাজছে। আমি বলি তোমাকে দেখতে চাই, সামনাসামনি কথা বলব। মেয়েটা হাসে, সামনাসামনি কথা বলতে হবে কেন , মোবাইলে তো কথা বলছিই। আমি নাছোরবান্দা , না একবার দেখা করি কি বল। মেয়েটা অবশেষে সম্মতি দেয়। আমার চেহারা কিন্তু খারাপ আপনি হতাশ হবেন। আমি মনে মনে বলি যার কথা এত সুন্দর সে দেখতে খারাপ হয় কেমনে। শুক্রবারে হেলভেশিয়াতে দেখা করার কথা বলি আমি। মেয়েটা বলে ঠিক আছে। আমি শিষ বাজাতে বাজাতে বাসায় ফিরি।

শুক্রবারে হেলভেশিয়াতে যথাসময়ে সেজেগুজে হাজির হই আমি। বসে থাকতে হয় অনেকক্ষন। রাস্তাঘাটের যে অবস্থা ।মেয়েটা মনে হয় জ্যামে আটকা পড়েছে।

ঘন্টাখানেক পর আমার বউ ঢোকে হেলভেশিয়াতে। আমার কাছে এসে বলে চল, বাসায় চল,অনেক হইছে। আমি আকাশ থেকে পড়ি। এতদিন কথা বলেও কন্ঠস্বর চিনতে পারলাম না। বন্ধুবান্ধবরা কি সাধে আর আবাল বলে আমাকে !

শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০০৮

সিগারেট

লোকটি দেখি বেশ ক্ষেপে গেছে। আমি বললাম ভুল হয়ে গেছে ,আর হবেনা। কিন্তু তিনি দমবার পাত্র নন। এটিকেট জানেন না যেখানে সেখানে সিগারেট খেয়ে বেড়ান,পারলে মনে হয় আস্ত মুন্ডুটাই আমার উড়িয়ে দেন তিনি। আমি মনে মনে সিগারেটের জাত তুলে গালাগালি শুরু করি । শালার সিগারেট ,এর জন্য চলন্ত ট্রেনে পর্যন্ত মানুষের গালি খেতে হচ্ছে । ভদ্রলোক আরো কিছুক্ষন গজরিয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসেন। আমার খুব বেশী দোষ ছিলনা। ট্রেনের দুই বগির মাঝখানে দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম আর খালি দরজার দিকে ধোঁয়া ছাড়ছিলাম , উনি যে এসময়ই নাযিল হবেন কে জানতে পেরেছিল। নিজের উপর বিরক্ত হয়ে আমিও সিটে গিয়ে বসি। ঘন্টাখানেক পর খাবার গাড়ি নামক ট্রেনে একটা বগিতে চা খেতে যাই।

খাবার গাড়িতে কয়েকজন মাত্র লোক ছিল। একজনকে দেখি কাটলেট চাবাচ্ছেন আরাম করে। ওনার তৃপ্তিভরে কাটলেট খাওয়া দেখে আমারও খেতে ইচ্ছে করে। অর্ডার দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসি। এসময়ই পিছনের দিকে ভদ্রলোকটিকে আবার দেখি। চা খাচ্ছেন ,হাতে সিগারেট। বেশ আরাম করেই খাবার গাড়িতে সিগারেট খাচ্ছেন ভদ্রলোকটি।

রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০০৮

খাম

অনেকদিন পর রাতে পুরনো ডায়েরিটা পড়ছিলাম । বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ডায়েরী।বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ডায়েরী লেখাকে একটা অভ্যাসে পরিনত করেছিলাম । স্বাভাবিকভাবেই নানান নষ্টালজিক ঘটনায় ঠাসা ডায়েরীটা। সেগুলোই এতদিন পর পড়ছিলাম।ডায়েরীর ভিতর একটা খাম পেলাম । সাদা,ছোট্র একটা খাম।খামের গায়ে আকাশী বর্ণের দু-তিনটি মিকিমাউস টাইপের কার্টুন আঁকা । আমি খামটি দেখতে থাকি,পরম মমতাভরে হাত বুলোতে থাকি খামের উপর। কেন জানি চোখ ভিজে আসতে থাকে আমার।মাথা নিছু করে ছিলাম।কয়েক ফোঁটা পানি গিয়ে পড়ে আমার চশমাটার উপর। ঝাপসা হয়ে ওঠে চশমাটা। আম্মা রুমে ঢুকে আমাকে ডাকেন কিরে কি হেয়েছে চোখে পানি কেন। আমি চেয়ারে ঝুলানো গামছাটা দিয়ে চোখ আর চশমাটা মুছি।না মাথাটা ব্যথা করছিল তো তাই একটু নিক্স লাগালাম মাথায়,চোখেও গেছে বোধহয় একটু। মিথ্যা কথাটা আমাকে বলতেই হয়। সাবধানে দিবিনা ,আমাকে বললেই হত লাগিয়ে দিতাম। মাথা ব্যথা করছে তো বসে আছিস কেন?আমি লাইট বন্ধ করে দিচ্ছি শুয়ে পড়। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে আম্মা লাইট নিভিয়ে চলে যান।আমি শুয়ে পড়ি।আমার চোখে মনাদের বাড়িটা ভেসে ওঠে।

বেশ বড়ই বাড়িটা।ঢাকা শহরে এরকম বড় বাড়ি খুব একটা চোখে পড়ে না। মেইন গেট পেরিয়ে বড় একটা বাগান পড়ে । বাগানের মধ্যে প্রসস্থ রাস্তাটা দিয়ে কিছুক্ষন হাটলে তবেই মূল দালানের গেটটা পাওয়া যায়। আমি মনাকে ওদের অদ্ভুদ ডিজাইনের বড় বাড়িটা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ও বলেছিলো ওদের দাদার বানানো বাড়ি। ঐতিহ্যের খাতিরে নাকি ভাঙা হয়নি। মনাদের শ্রেনীর লোকেরা ঐতিহ্য খুব পছন্দ করে তাই আমি আর বিশেষ কিছু বলিনি। মনাদের বাড়ীতে আমাকে কয়েকদিন যেতে হয়েছিলো।

/p>

মনাকে আমি পড়াতাম ,খুব বেশীদিন না অল্পদিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মফস্বলের স্কুল শিক্ষক বাবার কাছে কয়েকমাস টাকা নেওয়ার পর মনে হচ্ছিল না অনেক হয়েছে আর না এবার নিজেই কিছু করি। এক বন্ধুর মারফত গেলাম ওকে পড়াতে ঠিক ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার বারোদিন আগে। ফাইনাল রিভিশনের জন্য যাওয়া আরকি।প্রথমদিন মনাদের বাড়ীতে ঢুকতে একটু ভয় হয় আমার। বড়লোকদের বাড়ী,আগে কখনো এরকম বাড়িতে ঢোকা হয়নি। বিশেষত 'কুকুর হইতে সাবধান 'জাতীয় কথাবার্তা আমার জানা ছিল এবং তৎসংক্রান্ত দু একটি ঘটনাও কোথাও কোথাও পড়েছিলাম। তাই বড়লোক সংক্রান্ত আমার একটা ভয় ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেরকম কিছু হয়নি।গেটে একজন দাড়োয়ান দাড়ানো ছিল সে আমাকে আমার নাম আর আসার কারন বলামাত্র দরজা খুলে বাগানের রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়েছিল। হয়ত আগেই বলা ছিল।আমি মনাদের বাড়িটা দেখে অবাক হয়েছিলাম,অবাক হয়েছিলাম ওদের গাড়িগুলো দেখেও। একটা পরিবারের এতগুলো গাড়ীর কি দরকার হতে পারে কিছুতেই মাথায় ঢোকেনি আমার।

/p>

মনাকে পড়ানোমাত্র আমি আবিষ্কার করলাম সে দুনিয়াসম্পর্কিত অনেক সাধারণ জিনিস দেখেনি,বোঝেও না অনেককিছু। মনা কখনো খেজুর রস খায়নি ,চড়েনি নৌকায়ও। কুমড়ার ফুল দিয়ে যে বড়া বানানো যায় তা সে জানতনা। আমি বলার পর সে এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিল যেন আমি একটা কুখাদ্যর রেসিপি দিচ্ছি ওকে। আমি খুবই আশ্চর্য হয়ে জানতে পারি পাটগাছ ও ভুট্রাগাছ নামের যে দুটি অতি পরিচিত গাছ আছে তা মনা কখনো দেখেনি। সে মনে করেছিল ভুট্রাগাছ লিচু গাছের মত বড় কোন গাছ হবে। আমি মেয়েটার কথাবার্তা শুনে হাসি,অবাকও হই। মনার সরলতা আমার ভালই লাগে। নানান বিষয়ে কথা বলতে বলতে সময় গড়িয়ে যায়,পড়ানো হয়ে ওঠে সামান্যই। আমার আর মনার গল্প শেষ হয়না।

/p>

মেয়েদের সাথে আমি আগে এরকমভাবে কখনও মিশিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ওঠার আগে যখন বাড়িতে থাকতাম তখন বলা যায় একরকম এড়িয়েই চলতাম মেয়েদের। মেয়েদের সাথে কথা বলতে কেন জানি রাজ্যের লজ্জা ভর করত আমার ওপর। আম্মা ব্যাপারটা জানতেন তাই হল থেকে যখন ছুটিছাটায় বাড়িতে যেতাম তখন জিজ্ঞাসা করতেন কি রে কোন বান্ধবি -টান্ধবি হল। আমি আম্মার কথাটার মানে বুঝতাম আর একটু মুচকি হেসে বলতাম না,হল না। তাই মনার সাথে অনবরত কথা বলার সময় মনার মাঝে মেয়েদের নতুন করে আবিষ্কার করতে থাকি আমি। কথা বলার সময় মনা অকারনে খিলখিল করে হেসে ওঠে। কোন ছেলেবন্ধু হলে আমি নিশ্চিত বিরক্ত হতাম কিন্তু মনার এরকম অসংযত,অকারন হাসি আমার ভালো লাগে,এক ধরনের ভাললাগা তৈরী হতে থাকে মনার জন্য ,আগে যা কখনও হয়নি কোনো মেয়ের জন্য। আমি বুঝতে পারি আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি,কিন্তু এ দুর্বলতা আমি ঠেকাতে পারিনা।আমার খারাপ লাগতে থাকে। আমার অবস্থাগত কারনে দুর্বল হওয়ায় আমার খারাপ লাগতে থাকে,খারাপ লাগতে থাকে ছাত্রীর প্রতি দুর্বল হওয়াতেও। আমি নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকি।

/p>

বারোদিন পড়ানো হয়ে গেলে মনা আমাকে সাদা খামটি দেয়। বলে ভাইয়া আম্মু দিয়েছে। এর আগে আমি কখনো পড়ানো বাবদ খামভর্তি টাকা নেইনি। একটু বিব্রতবোধ হয় আমার। চট করে খামটি সামনের পকেটে রাখি।মনাকে আর পড়ানো হবেনা,হয়ত দেখাও হবেনা কখনও ভাবনাটা মাথায় চেপে থাকে । মনটা ভারী হয়ে ওঠে আমার। যন্ত্রের মত পড়াই আমি,কোন গল্প হয়ে ওঠেনা সেদিন। পড়ানো হয়ে গেলে আমি বলি মনা আজকে তাহলে যাই,ভালোভাবে পরীক্ষা দিও। মনা বলে, আচ্ছা। আমি মনার কিছু বলার জন্য বৃথা অপেক্ষা করতে থাকি। মনা কিছু বলেনা,চুপ করে থাকে,ফোন আসে ফোন ধরে কথা বলতে থাকে। আমি বসেই থাকি,কেন জানি যেতে ইচ্ছে করেনা। মনা ফোন কেটে দিয়ে আমার দিকে তাকায়,আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। আমি বসে আছি কেন মনার তো কিছু বলার কথা নয়,কেউ একজন ভিতে থেকে আমাকে নাড়া দেয়।আমাকে উঠতেই হয়। আমি বলি ঠিক আছে গেলাম। দরজার দিকে পা বাড়াই আমি,মনাও দেখি দরজা পর্যন্ত আসে।আমার বুকের ভিতরটায় ধক করে ওঠে,আমি দরজায় গিয়ে দাড়াই। মনা কি কিছু বলবে,আশান্বিত আমি চেয়ে দেখি মনার দিকে।মনা বলে ভাইয়া দোয়া করবেন,চান্স পেলে খাওয়াব।আমি বলি হ্যাঁ দোয়াতো করবই। দরজার সামনের লনটাতে পা বাড়াই আমি।

মনাদের বাড়ী থেকে এই একটি খাম নিয়ে আমি ফিরে আসি। মনার সাথে আমার আর কখনও দেখা হয়নি। এই পৃথিবীতে কেইবা কাউকে মনে রাখে!মাঝে মাঝে আমি খামটা বের করে দেখতাম। মনার কথা চিন্তা করতাম,কেমন আছে বোকা মেয়েটা! আমি হয়ত তখনও বুঝিনি মনার কাছ থেকে এই একটিমাত্র খামের বেশী আর কিছু পাওয়ার যোগ্যতা আমার ছিল না।

বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০০৮

মোফাকখারুল

সপ্তাহে পাঁচদিন সকাল আটটার সময় আমার মেজাজ খারাপ থাকে।কারন ঐ পাঁচদিন আটটায় ক্লাস থাকে।রাত চারটা-পাঁচটা পর্যন্ত জেগে থেকে কেইবা আটটায় ক্লাস নামক জিনিসটা করতে যায়।তারপরেও যাই,ভাগ্যের ফেরে যেতে হয়।পিছনের বেন্চে বসে বই সামনে নিয়ে পড়ার ভান ধরে ঝিমুতে থাকি।সেদিনও সকালে ঝিমুচ্ছিলাম,মনুষ্যকন্ঠে আমার নাম শুনে তন্দ্রাবিলোপ ঘটে।"এই কায়েস ঘুমাচ্ছিল"।আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।কোন শালা আবার সাতসকালে ডাকাডাকি করে।আমি চোঁখ মেলে চাই,মোফাকখারুল ডাকছে।আমি মোফাকখারুলকে দেখে অবাক হই।এই ফাষ্ট বেন্চার এখানে কি করছে। মোফাকখারুল করুনামাখা কন্ঠে বলে কায়েস আমিতো শেষ।আমি মোফাকখারুলের শেষ হওয়ার কোন কারন খুঁজে পাইনা।

যুগপৎভদ্র এবং বলদ(!) ছেলে মোফাকখারুল।সকালে বাপের গাড়ীতে চেপে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে আসে,প্রথম বেন্চে বসে আটটা থেকে একটা পর্যন্ত মাছিমাড়া কেরানীর মত স্যারদের লেকচার তোলে,ল্যাব থাকলে আড়াইটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে ল্যাব করে,মাঝের এক-দেড় ঘন্টা বাসা থেকে আনা কাটলেট আর সেন্ডুইচ খেয়ে লাইব্রেরীতে পড়াশুনা করে আর ক্লাসটেষ্টে অনবরত বিশে বিশ পেতে থাকে।ক্লাসের সুন্দরী মেয়েরা মোফাকখারুলের সাথে ন্যাকামি করে,একটু পড়াটা বুঝাওনা মোফাকখারুল। আমার মেজাজটা খারাপ হয়।শালা মর তুই!কিন্তু আমি জানি এ একটা আধা না পুরা বলদ,দুনিয়াদারী সম্বন্ধে এর কোন আইডিয়া নাই।কোথা থেকে একদিন শুনে এসেছে নীল ছবি নামে একধরনের ছবি আছে তারপর দু-তিনদিন আমাকে জ্বালিয়েছে নীল ছবি কি,নীল ছবি কি বলে।আমি বলিনি ,বলেছি আছে না কত ধরনের ছবি আছে দুনিয়ায়,এটা মনে হয় কোন বিশেষ দেশের তৈরি ছবি।বেটা বিশ্বাস করেছে,বলদ না!বিশ্বাস তো করবেই।তো মোফাকখারুলের সমস্যার কথা শুনে আমারও কিছুটা কৌতুহলের উদ্রেক হয়।আমি বলি ক্যান কি হইছে।সে আবার বলে কায়েস আমি তো শেষ,মানুষে আমাকে খারাপ ভাবছে।আমি বলি আরে খুলে বল তো কি হইছে।সে বলে নীলা নাকি তাকে বলেছে সে নাকি খুব অশ্লীল।তার সাথে আর কথা বলবে না।
-ক্যানো তুমি তাকে কি বলছ
-আরে আমি বলেছি তুমি কি পেন্টিটা পড়ছ
আমি ভাবি কাম সারছে আজ।আমি জানতে চাই আর কি সে বলছে।
- আর কি বলব।এই কথা বলার পরেই তো সে মুখ লাল করে ফেলল।আমি বললাম আমি গতকাল পেন্টি পড়েছি।খুব ভালো লাগছে পেন্টিটা পড়ে।অনেক জিনিসই তো পড়লাম,কিন্তু এটার মত ভাল লাগলো না কিছু।আমি বললাম পেন্টির কথা বলা তোমার ঠিক হয়নি।ও আকাশ থেকে পড়ে।বলে
-আরে কত কিছুই তো আমরা সংক্ষেপে বলি।ডাটা কমুনিকেশন কোর্সটাকে গতবার ডাটাকম বললামনা,প্যাটার্ন রিকগনিকেশনকেও তো পিআর বলি।আমি বলি হ্যাঁ ঠিক আছে,কিন্তু,,,,।ও আমার কথা শেষ করতে দেয়না।
-ডাটা কমুনিকেশনকে ডাটাকম,প্যাটার্ন রিকগনিকেশনকে পিআর বললে সমস্যা যদি না থাকে তাহলে মাইক্রোপ্রসেসর কোর্সের ইন্টেলের পেন্টিয়াম মাইক্রোপ্রসেসরকে পেন্টি বলতে সমস্যা কোথায়।স্যারই তো একদিন বলেছিল।

আমি বিষম খাই।মাছি মারা কেরানী ছাত্র হওয়ার বিপদ বুঝতে পারি।মোফাকখারুলকে আসল কথা বলিনা।শালা মেয়েদের সাথে দহরম-মহরম,নে এবার বোঝ ঠেলা।এবার যদি মেয়েদের ন্যাকামিটা কমে।আমি মিটিমিটি হেসে আবার ঝিমুতে থাকি।

চোর

মফস্বল শহরে বাসা পাল্টানো খুবই ঝামেলার কাজ।ওখানে ঢাকার মত প্যাক এন্ড মুভ জাতীয় সংস্থা থাকেনা।তবু কাজটা প্রায়ই করতে হয়।বাবা সরকারী চাকুরী করেন,বদলীর চাকুরি।গড়ে তিন বছরে একবার বদলী।আমরা দেশের বাড়ী থেকে দু-চারজন লোকজন আনি জিনিসপত্র আনা নেওয়া করার জন্য।একবার বদলীর পর নতুন বাসায় আমার ছোট্ট ওয়াকম্যানটা খুঁজে পাইনা।আম্মাকে বলি ।আম্মা দোষ দেন দেশ থেকে আসা লোকগুলোর।"বুঝিস না চোর-ছ্যাচ্চর এর জাত ,যা চোখে পড়ে তাই নিয়ে যায়।আমিওতো দরজার একটা সাদা পর্দা পাচ্ছিনা।" কাজের মেয়েটা বলে "ভাইজান এরা চুর,আমরার চেনটা নিছে,বিচরাইতেছি,পাইত্যাছি না,"।আব্বা অফিস থেকে ফিরলে আম্মা বিচার দেন কি লোক নিয়া আসছ,বাসার নানান জিনিস সরাইছে।আব্বা বলেন দেশের বাড়ী থেকেই তো লোক নিয়া আসলাম,এরা চুরি করলে কি করবা।আম্মা গজরাতে থাকেন।আমি ভাবি শালা চোরের দেশ,সব শালা চোর।চোরের চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করে রাতে ঘুমাতে যাই।

পরদিন সকালে নতুন কেনা আলমিরাটা খুলতে গিয়ে ওয়াকম্যান আর দরজার সাদা পর্দাটা পাওয়া যায়।

জায়গা করে নিতে হবে

যারা আমাকে শিখিয়েছিল এতদিন
একটি কথাই বলেছিল তারা বারবার
আমার নিজস্ব কোন জায়গা নেই
জায়গা করে নিতে হবে
পিঁপড়ার সারিতে যেমন করে জায়গা করে নেয় পিঁপড়ারা।

কিছু কিছু লোক আছে
জায়গা করা যাদের হয়ে ওঠে না
যাদের জায়গাটাতেই জায়গা করে নেয় কেউ কেউ
নিঃসঙ্গ পিঁপড়াদের মতই যেন তারা
মাঝে মাঝে আমিও এইসব লোকেদের দলে পড়ে যাই ।

সোমবার, ৭ এপ্রিল, ২০০৮

তুমি বিষয়ক

১।ফুটন্ত কলি স্পন্দিত হচ্ছে নির্বিঘ্নে
লাভ কার গোলাপ গাছ তোমার না ভ্রমরার ?

চাক ভেঙে মৌ মৌ করে উঠছে মধু
লাভ হচ্ছে কার জারুল গাছ তোমার না মৌমাছির ?

তুমি দুলে উঠছ অক্লেশে
সর্বাঙ্গ শরীর থেকে মুছে ফেলছো অন্ধকার
চিবুক ,স্তনে অবিরাম চাষ হচ্ছে গোলাপ
বসরার সুগন্ধি লাল গোলাপ
বলে দেবে একবার লাভ হবে কার
আমার না তোমার বর্বর স্বামীর ?

২। তুমিই তো কেড়ে নিয়েছিলে সব
মধু ,পড়তে পড়তে শরীরে ছড়ানো
দেখ তাই মৌমাছিরা বড় অসহায়
মধু ভেবে মানব রাবারে হুল ফোটায়।

রবিবার, ৬ এপ্রিল, ২০০৮

মানিব্যাগ,আমার মানিব্যাগ

একটি মানিব্যাগের স্বপ্ন আমার ছোটবেলা থেকেই । বাবা-চাচাকে মানিব্যাগ পকেটে করে সগর্বে হাটতে দেখে আমারও একটি মানিব্যাগের গর্বিত মালিক হওয়ার ইচ্ছে জাগে । চাচাকে দেখতাম মানিব্যাগের মধ্যে দুনিয়ার যাবতীয় কাগজপত্র নিয়ে ঘুরতেন । জানতে চাইলে বলতেন বড় হ বুঝবি।হ্যাঁ বড় হওয়ার আগে যে মানিব্যাগ কেনার টাকা পওয়া যাবে না তা আমি জানতাম । তাই প্রথমদিকে মানিব্যাগ দেখেই দর্শনতৃপ্তি লাভ করতে হত,কিন্তু আত্বতৃপ্তি পেতাম না। না। বাসায় আত্বীয়স্বজন বেড়তে আসলে আমি প্রাথমিক আলোচনার পরেই তাদের মানিব্যাগ দেখতে চাইতাম। তাদের অধিকাংশই বিরক্ত হত , মুখে বলত না কিছু কিন্তু বাসায় ঝাড়িটা খেতাম ঠিকই।

ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় প্রবলভাবে মানিব্যাগপ্রাপ্তির আশা চেপে বসল আমার মনে। পণ করলাম যে করেই হোক এ জিনিস আমাকে একটা অধিকার করতেই হবে। কিন্তু চাইলেই তো সব হয় না তার জন্য দরকার উপযুক্ত কার্যকরন।চেষ্টার কমতি ছিল না আমার। একটি মানিব্যাগের জন্য আমি নানানভাবে টাকাপয়সা নয়-ছয় শুরু করতে লাগলাম। আম্মা অফিস থেকে ফিরলেই অপেক্ষা করতাম কখন রান্নাঘরে যাবেন আর আমি আলগোছে আলমারীতে রাখা ওনার অফিসব্যাগ থেকে এক-দুইটা একটাকার পয়সা সরিয়ে ফেলব
না। আব্বার জন্য অপেক্ষা করতাম দুপুরে,কখন দুপুরের ভাত খেয়ে আব্বা ঘুমাবেন আর আমি হ্যাংগারে রাখা শার্ট থেকে দু-একটা টাকা সরাব। এভাবে নানান কাটখড় পুড়িয়ে চল্লিশ টাকার বিনিময়ে এক হাটের দিনে মফস্বলের বাজার থেকে একটি মানিব্যাগ কিনলাম,গর্বিত মালিক হলাম একটি মানিব্যাগের। ছোট চাচার মত অজস্র কাগজ ভরিয়ে পেট মোটা করে ফেললাম মানিব্যাগের। স্কুলে গিয়ে পকেটে মানিব্যাগ নিয়ে বুক ফুলিয়ে হাটি,কারনে-অকারনে অন্যদের সামনে বের করে উল্টেপাল্টে দেখি।বন্ধুদের বলি দেখ,মানিব্যাগ দেখ,আমার,তোর আছে এরকম।বন্ধুরা ঈর্ষায় জ্বলে,ওরাও মানিব্যাগের স্বপ্ন দেখা শুরু করে। কিন্তু সুখের দিন আমার বেশিদিন স্থায়ী হয়না।এক ছুটির দিনে দুপুরে কাপড় কাচতে গিয়ে আম্মা দেখে ফেলেন আমার গোপন সম্পত্তি। কখন,কোথায়,কিভাবে পেয়েছি তা নিয়ে জেরা চলতে থাকে।বলাতো যায়না চুরি করা টাকা দিয়ে মানিব্যাগ কিনেছি তাই নানান সময়ে নানান কথা বলতে হয়।ধোপে টেকেনা আমার যুক্তি।সীজ হয়ে যায় আমার সাধের মানিব্যাগ। কিন্তু তবুও আমার একটি মানিব্যাগের স্বপ্ন শেষ হয়না। বৈধভাবে আমার প্রথম মানিব্যাগ কেনা হয় এস,এস,সি পাশ করে মফস্বল থেকে জেলা শহরে কলেজে ভর্তি হওয়ার সময়। এবার আর কাউকে বলতে হয়না,বাসা থেকেই টাকা দিয়ে দেয় মানিব্যাগ কেনার জন্য। পয়ষট্রি টাকা দিয়ে কালো রঙের মানিব্যাগ কিনি একটি। ছোটখাট একটা ভল্ট হিসেবে ব্যবহার শুরু করি একে। বাসা থেকে পাঠানো আম্মার চিঠি,সময়ে অসময়ে লেখা ছড়া-কবিতা,নানান ধরনের দলিল-দস্তাবেজ ভরে ফেলি এতে। ধীরে ধীরে আমার ব্যক্তিগত এনসাইক্লোপেডিয়া হয়ে ওঠেমানিব্যাগটি। ধীরে ধীরে আমার অস্তিস্তের সাথে মিশে যেতে থাকে মানিব্যাগটি। আমাকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয় এর অস্তিস্ত রক্ষায়। মানিব্যাগ রাখার জন্য নতুন বানানো প্যান্টগুলোতে দর্জির কাছে গিয়ে পিছনের পকেটের উপরে বোতামসহ ঢাকনা বানিয়ে আনি , মেসে ঘুমানোর সময় বালিশের নিচে রাখি, বাসে বা ভীড়ের মধ্যে চলাচলের সময় মাঝে মাঝে হাত রাখি পকেটে, বুঝতে চেষ্টা করি ঠিক আছে তো সব। এভাবে মানিব্যাগটির সাথে আত্বীয়তা করে সময় গড়িয়ে যায় আমার। কিন্তু শেষরক্ষা শেষ পর্যন্ত হয়না। এইচ,এস,সি পাশের পর ঢাকায় এসে মানিব্যাগটি বেহাত হয়ে যায়। মফস্বল থেকে সদ্য পাশ করা বোকা এই আমি জানতাম না এই শহরে দিনদুপুরে লোকজন অন্যের জিনিসপত্রে চোঁখ দেয়,ছিনিয়ে নেয় জোর করে। একান্ত বন্ধুর মত সবসময় সাথে থাকা মানিব্যাগটি হারিয়ে আমি যেন র্নিবান্ধব হয়ে পড়ি, মানিব্যাগটিতে থাকা জিনিসপত্রগুলোর জন্য হয়ে পড়ি কাতর । সর্বোপরি মানিব্যাগটির শোকে কাতর আমাকে আরো কয়েকমাস মানিব্যাগবিহীন থাকতে হয়।

বু্য়েটে ভর্তি হই।স্বাভাবিকভাবে জীবন চলতে থাকে,একটু ভালোভাবে থাকার জন্য টিউশনি ধরি। মাসশেষে অনেকগুলো টাকা ওঠে হাতে। বন্ধু-বান্ধব অনেকে বলে পুরানো মোবাইল ব্যবহার করিস একটা নতুন মডেলের মোবাইল নে। আমি মোবাইল কেনার জন্য মার্কেটে যাই কিন্তু ফিরে আসি মেন্জ ক্লাব থেকে পনেরস টাকা দিয়ে মানিব্যাগ কিনে। বন্ধুরা যারা আমার মানিব্যাগের ঘটনাবলী জানে তারা হাসে,বলে আবার মানিব্যাগ। অনেকে বলে শুধু টাকা রাখার জন্য এত টাকার মানিব্যাগ,অপচয়,পুরোটাই অপচয়। ওরাতো জানে না মানিব্যাগ শুধু আমার কাছে একটি অর্থথলি নয়,এটা আমার ভল্ট,আমার বন্ধু। আবার আমার মানিব্যাগের মোটা হতে শুরু করে।স্থান পেতে শুরু করে পত্র থেকে শুরু করে সদ্য কেনা ঘড়ির দোকেনের ম্যামো পর্যন্ত । কিন্তু এবারও শেষরক্ষা হয়না। এক ফাল্গুনের দুপুরে ল্যাব থেকে ফিরে এসে যখন প্রবলভাবে ঘুমাই তখন হলে আমার রুম থেকে চুরি হয়ে যায় মানিব্যাগটি। এবার আমাকে অনেক যন্ত্রনা পোহাতে হয়। হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড হারানোতে থানায় জিডি করতে হয়,ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড হারানোতে পাঁচশত টাকা দিয়ে নতুন করে তুলতে হয় ক্রেডিট কার্ড । আমার আফসোস বাড়ে ইস! আরএকটু যত্ন করে যদি রাখতাম মানিব্যাগটি।আফসোস করতে করতে আমি আবারো একটি নতুন মানিব্যাগ কেনার স্বপ্ন দেখি।