সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০০৮

একটি অসমাধাকৃত ছিনতাই (বাস্তব)

২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা।

পলাশী থেকে যাত্রা শুরু করলাম । উদ্দেশ্য মধুবাগ ,এক ছাত্রীকে পড়াতে যেতে হবে । কোন রিকশা নাই । পলাশীতে অনেক সময় রিকশা পাওয়া যায়না , ভাবলাম একটু হাঁটি নীলক্ষেত পর্যন্ত যাই। নীলক্ষেতেও দেখি কোন রিকশা নাই । কি মসিবত। হেঁটে আবারও শাহবাগ পর্যন্ত এলাম ,দেখি ওখানে কি অবস্থা । তখন সদ্য মফস্বল শহর থেকে এসেছি , হাঁটাহাটি কোন বিষয় ছিলনা। শাহবাগে এসে শুনলাম রিকশা ধর্মঘট , সারা শহরে রিকসা চলাচল বন্ধ । কি বিপদ , এখন কেমনে যাই। একবার ভাবলাম হলে ফিরে যাই এতদূর কষ্ট করে যাই কিভাবে । পরে ভাবলাম শাহবাগ পর্যন্ত যখন এসেছিই দেখি হেঁটেই যাই আজকে , পায়ের যা হবার হবে । যা ভাবা তাই কাজ । শাহবাগ থেকে রমনা ,শিল্পকলা একাডেমি, কাকরাইল হয়ে পৌছালাম কর্নফুলী গার্ডেন সিটির সামনে । তখনই ভদ্রলোকটির(!) সাথে আমার দেখা । আমি দ্রুত সামনে যাচ্ছি উনি ডাকলেন এই যে ভাই ।আমি পিছনে ফিরে চাই।
-পায়ে লাগল সরি বললেন না।
আমি ভাবলাম কি ব্যাপার পায়ে লাগল কখন ? আচ্ছা ভুল করে লাগতে পারে ,দ্রুত হাটছিলাম । আমি বলি
-ও পায়ে লেগেছে নাকি ! সরি আসলে আমি খেয়াল করি নাই।
ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে আসেন । হাতে হাত মেলান।
-আপানার নাম।
-কায়েস।
-কৈ যাবেন।
-মধুবাগ যাব।
-থাকেন কৈ ,কি করেন।
-পলাশী থাকি। বুয়েটে পড়ি ,ওখানে হলে থাকি।
-ও আচ্ছা । আপনার মোবাইলটা একটু দেবেন । একটা জরুরী কল করা লাগত ।

আমি ভাবি ভদ্রলোক যখন বিপদে পড়েছেন দেই মোবাইলটা। তাছাড়া তখনও সদ্য মফস্বল আগত আমি জানতাম না এই শহরে মানুষ রাস্তাঘাটে কত ফিকির নিয়ে ঘোরে। আমি মোবাইলটা এগিয়ে দেই। লোকটি মোবাইল নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে । আমার সন্দেহ হয় । অবচেতন মন থেকে কে যেন বলে মোবাইলটা নাও ,এই লোকের উদ্দেশ্য ভাল না। ওসময় মাথা ঠিক ছিলনা । আমি তাই যা-তা বলি ,ভাই একটা নাম্বার আছে দেন ওটা ডিলিট করেই আপনাকে দিচ্ছি। লোকটা প্রথমে একটু ইতস্তত করে । আমি আরেকটু জোর করলে উনি দিয়ে দেন । আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকি । উনি বলেন মোবাইল দেন । আমি বলি না ভাই মোবাইল দেয়া যাবেনা। এবার পাশ থেকে আরেকজন লোক আসে । লোকটা বলে-
-আমাদের ভাই মোবাইল চাইছে আর তুই দিলি না । এনারে চিনস । সেভেন মার্ডার বিপু বললে এনারে সবাই চেনে । মোবাইলটা দে ।লোকটা আমার হাতটা সেভেন মার্ডারের কোমড়ে ধরে । ওখানে পিস্তল টাইপ একটা জিনিস অনুভব করি। কিন্তু আমিও তখন মফস্বলের গোঁড়ার তরুন। এত লোকের মাঝে মোবাইল নিবা , এত সোজা , দেখি কি কর তোমরা ।সেভেন মার্ডার এবার ভাষার ভদ্রতা হারান।
-তোরে এখানে কেউ মাইরা রাখলে কেউ দেখব । চিল্লাবি চিল্লা দেখি। দেখ কেউ আসে কিনা । এই এরে ধর নিয়ে যাই চিপায়। শালার হাত পা আজকে ভেঙে দেওয়া লাগবে ।ঐ সময়ে ১৮ বছরের একজন তরুনকে ভয় দেখানোর জন্য এটা যথেষ্ট ছিল (এখন হলে তো সরাসরি দিয়েই দেব!)। কিন্তু কেন জানি ঐ সময়ে আমি গোয়ার্তুমির চূড়ান্ত করি।
-না মোবাইল দেওয়া যাবেনা।
লোকটা কিছুক্ষন আমাকে দেখে । ওনার চোখে আমি অবিশ্বাস দেখি। এরকম ঘটনায় মনে হয় আর কখনো পড়েনি আগে। কি করবে বুঝে উঠতে কিছুক্ষন সময় লাগে তার।
-দিবিনা। আচ্ছা যা । আর য্যান তোরে দেখিনা এ এলাকায়।

আমি বিদাই হই । ছাত্রীকে গিয়ে বলি আগে এক গ্লাস পানি নিয়ে আস।এরপর আমি কয়েকজনকে ঘটনাটা বলেছি। অনেকে বিশ্বাস করেছে , অনেক ভেবেছে চাপা মারছি । কেউ বলেছে এত সাহস তোমার , ঘুমাও ক্যামনে রাতে।
আমি কিছু বলিনি। মুচকি হেসেছি।

রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০০৮

দুটি পরমানু গল্প

১। ক্যালিফোর্নিয়ার অগ্নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা দাবানলে পুড়ে যাওয়া বনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ করতে একাংশে আংশিক পোড়া মৃতদেহ দেখতে পায় । মৃত লোকটি ছিল ভেজা সাঁতারের পোষাক ,ফ্লিপার (সাঁতার কাটার জন্য তাড়নীবিশেষ) আর মুখোশ পরিহিত । পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টে বলা হয় লোকটি আগুনে পুড়ে মারা যায়নি বরং মারা গেছে অভ্যন্তরীণ জখমের কারনে । তদন্তকারীরা তদন্ত করে উদঘাটন করেন আসল তথ্য।
দুর্ঘটনার দিন লোকটি বন থেকে মাইলবিশেক দূরে সাগরে যায় সারফিং করতে । দমকল বাহিনীর লোকজন যত দ্রুত সম্ভবআগুন নেভানোর জন্য বিশাল বিশাল বাকেটওয়ালা (বড় বালতি জাতীয়) হেলিকপ্টার ব্যবহার করে । বাকেটগুলো দ্রুত ভরার জন্য সমুদ্রে ফেলা হয় এরপর বনে খালি করা হয় পানি ফেলে । বেচারা লোকের ভাগ্য এমন তার আশ্রয় হয় এমনই একটা বাকেটে । বেচারা!

২। আয়ারল্যান্ডের লোকেরা কৃপণ বলে বেশ খ্যাত । এমনি একজন ভাবি আইরিশ দম্পতির মধ্য কথোপকথন ।
স্ত্রী : তোমার মত কৃপণ লোককে বিয়ে করব না । এই নাও তোমার বাগদানের আংটি ।
পুং: আংটি না হয় দিলে কিন্তু আংটির কেসটা কোথায় । (শেষ)

শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০০৮

ধরা

মেয়েটাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে , এমন রিনরিন করে কথা বলে যেন মনে হয় কোথাও হাল্কা স্বরে বাশিঁ বাজছে। আমি বলি তোমাকে দেখতে চাই, সামনাসামনি কথা বলব। মেয়েটা হাসে, সামনাসামনি কথা বলতে হবে কেন , মোবাইলে তো কথা বলছিই। আমি নাছোরবান্দা , না একবার দেখা করি কি বল। মেয়েটা অবশেষে সম্মতি দেয়। আমার চেহারা কিন্তু খারাপ আপনি হতাশ হবেন। আমি মনে মনে বলি যার কথা এত সুন্দর সে দেখতে খারাপ হয় কেমনে। শুক্রবারে হেলভেশিয়াতে দেখা করার কথা বলি আমি। মেয়েটা বলে ঠিক আছে। আমি শিষ বাজাতে বাজাতে বাসায় ফিরি।

শুক্রবারে হেলভেশিয়াতে যথাসময়ে সেজেগুজে হাজির হই আমি। বসে থাকতে হয় অনেকক্ষন। রাস্তাঘাটের যে অবস্থা ।মেয়েটা মনে হয় জ্যামে আটকা পড়েছে।

ঘন্টাখানেক পর আমার বউ ঢোকে হেলভেশিয়াতে। আমার কাছে এসে বলে চল, বাসায় চল,অনেক হইছে। আমি আকাশ থেকে পড়ি। এতদিন কথা বলেও কন্ঠস্বর চিনতে পারলাম না। বন্ধুবান্ধবরা কি সাধে আর আবাল বলে আমাকে !

শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০০৮

সিগারেট

লোকটি দেখি বেশ ক্ষেপে গেছে। আমি বললাম ভুল হয়ে গেছে ,আর হবেনা। কিন্তু তিনি দমবার পাত্র নন। এটিকেট জানেন না যেখানে সেখানে সিগারেট খেয়ে বেড়ান,পারলে মনে হয় আস্ত মুন্ডুটাই আমার উড়িয়ে দেন তিনি। আমি মনে মনে সিগারেটের জাত তুলে গালাগালি শুরু করি । শালার সিগারেট ,এর জন্য চলন্ত ট্রেনে পর্যন্ত মানুষের গালি খেতে হচ্ছে । ভদ্রলোক আরো কিছুক্ষন গজরিয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসেন। আমার খুব বেশী দোষ ছিলনা। ট্রেনের দুই বগির মাঝখানে দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম আর খালি দরজার দিকে ধোঁয়া ছাড়ছিলাম , উনি যে এসময়ই নাযিল হবেন কে জানতে পেরেছিল। নিজের উপর বিরক্ত হয়ে আমিও সিটে গিয়ে বসি। ঘন্টাখানেক পর খাবার গাড়ি নামক ট্রেনে একটা বগিতে চা খেতে যাই।

খাবার গাড়িতে কয়েকজন মাত্র লোক ছিল। একজনকে দেখি কাটলেট চাবাচ্ছেন আরাম করে। ওনার তৃপ্তিভরে কাটলেট খাওয়া দেখে আমারও খেতে ইচ্ছে করে। অর্ডার দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসি। এসময়ই পিছনের দিকে ভদ্রলোকটিকে আবার দেখি। চা খাচ্ছেন ,হাতে সিগারেট। বেশ আরাম করেই খাবার গাড়িতে সিগারেট খাচ্ছেন ভদ্রলোকটি।

রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০০৮

খাম

অনেকদিন পর রাতে পুরনো ডায়েরিটা পড়ছিলাম । বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ডায়েরী।বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ডায়েরী লেখাকে একটা অভ্যাসে পরিনত করেছিলাম । স্বাভাবিকভাবেই নানান নষ্টালজিক ঘটনায় ঠাসা ডায়েরীটা। সেগুলোই এতদিন পর পড়ছিলাম।ডায়েরীর ভিতর একটা খাম পেলাম । সাদা,ছোট্র একটা খাম।খামের গায়ে আকাশী বর্ণের দু-তিনটি মিকিমাউস টাইপের কার্টুন আঁকা । আমি খামটি দেখতে থাকি,পরম মমতাভরে হাত বুলোতে থাকি খামের উপর। কেন জানি চোখ ভিজে আসতে থাকে আমার।মাথা নিছু করে ছিলাম।কয়েক ফোঁটা পানি গিয়ে পড়ে আমার চশমাটার উপর। ঝাপসা হয়ে ওঠে চশমাটা। আম্মা রুমে ঢুকে আমাকে ডাকেন কিরে কি হেয়েছে চোখে পানি কেন। আমি চেয়ারে ঝুলানো গামছাটা দিয়ে চোখ আর চশমাটা মুছি।না মাথাটা ব্যথা করছিল তো তাই একটু নিক্স লাগালাম মাথায়,চোখেও গেছে বোধহয় একটু। মিথ্যা কথাটা আমাকে বলতেই হয়। সাবধানে দিবিনা ,আমাকে বললেই হত লাগিয়ে দিতাম। মাথা ব্যথা করছে তো বসে আছিস কেন?আমি লাইট বন্ধ করে দিচ্ছি শুয়ে পড়। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে আম্মা লাইট নিভিয়ে চলে যান।আমি শুয়ে পড়ি।আমার চোখে মনাদের বাড়িটা ভেসে ওঠে।

বেশ বড়ই বাড়িটা।ঢাকা শহরে এরকম বড় বাড়ি খুব একটা চোখে পড়ে না। মেইন গেট পেরিয়ে বড় একটা বাগান পড়ে । বাগানের মধ্যে প্রসস্থ রাস্তাটা দিয়ে কিছুক্ষন হাটলে তবেই মূল দালানের গেটটা পাওয়া যায়। আমি মনাকে ওদের অদ্ভুদ ডিজাইনের বড় বাড়িটা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ও বলেছিলো ওদের দাদার বানানো বাড়ি। ঐতিহ্যের খাতিরে নাকি ভাঙা হয়নি। মনাদের শ্রেনীর লোকেরা ঐতিহ্য খুব পছন্দ করে তাই আমি আর বিশেষ কিছু বলিনি। মনাদের বাড়ীতে আমাকে কয়েকদিন যেতে হয়েছিলো।

/p>

মনাকে আমি পড়াতাম ,খুব বেশীদিন না অল্পদিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মফস্বলের স্কুল শিক্ষক বাবার কাছে কয়েকমাস টাকা নেওয়ার পর মনে হচ্ছিল না অনেক হয়েছে আর না এবার নিজেই কিছু করি। এক বন্ধুর মারফত গেলাম ওকে পড়াতে ঠিক ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার বারোদিন আগে। ফাইনাল রিভিশনের জন্য যাওয়া আরকি।প্রথমদিন মনাদের বাড়ীতে ঢুকতে একটু ভয় হয় আমার। বড়লোকদের বাড়ী,আগে কখনো এরকম বাড়িতে ঢোকা হয়নি। বিশেষত 'কুকুর হইতে সাবধান 'জাতীয় কথাবার্তা আমার জানা ছিল এবং তৎসংক্রান্ত দু একটি ঘটনাও কোথাও কোথাও পড়েছিলাম। তাই বড়লোক সংক্রান্ত আমার একটা ভয় ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেরকম কিছু হয়নি।গেটে একজন দাড়োয়ান দাড়ানো ছিল সে আমাকে আমার নাম আর আসার কারন বলামাত্র দরজা খুলে বাগানের রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়েছিল। হয়ত আগেই বলা ছিল।আমি মনাদের বাড়িটা দেখে অবাক হয়েছিলাম,অবাক হয়েছিলাম ওদের গাড়িগুলো দেখেও। একটা পরিবারের এতগুলো গাড়ীর কি দরকার হতে পারে কিছুতেই মাথায় ঢোকেনি আমার।

/p>

মনাকে পড়ানোমাত্র আমি আবিষ্কার করলাম সে দুনিয়াসম্পর্কিত অনেক সাধারণ জিনিস দেখেনি,বোঝেও না অনেককিছু। মনা কখনো খেজুর রস খায়নি ,চড়েনি নৌকায়ও। কুমড়ার ফুল দিয়ে যে বড়া বানানো যায় তা সে জানতনা। আমি বলার পর সে এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিল যেন আমি একটা কুখাদ্যর রেসিপি দিচ্ছি ওকে। আমি খুবই আশ্চর্য হয়ে জানতে পারি পাটগাছ ও ভুট্রাগাছ নামের যে দুটি অতি পরিচিত গাছ আছে তা মনা কখনো দেখেনি। সে মনে করেছিল ভুট্রাগাছ লিচু গাছের মত বড় কোন গাছ হবে। আমি মেয়েটার কথাবার্তা শুনে হাসি,অবাকও হই। মনার সরলতা আমার ভালই লাগে। নানান বিষয়ে কথা বলতে বলতে সময় গড়িয়ে যায়,পড়ানো হয়ে ওঠে সামান্যই। আমার আর মনার গল্প শেষ হয়না।

/p>

মেয়েদের সাথে আমি আগে এরকমভাবে কখনও মিশিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ওঠার আগে যখন বাড়িতে থাকতাম তখন বলা যায় একরকম এড়িয়েই চলতাম মেয়েদের। মেয়েদের সাথে কথা বলতে কেন জানি রাজ্যের লজ্জা ভর করত আমার ওপর। আম্মা ব্যাপারটা জানতেন তাই হল থেকে যখন ছুটিছাটায় বাড়িতে যেতাম তখন জিজ্ঞাসা করতেন কি রে কোন বান্ধবি -টান্ধবি হল। আমি আম্মার কথাটার মানে বুঝতাম আর একটু মুচকি হেসে বলতাম না,হল না। তাই মনার সাথে অনবরত কথা বলার সময় মনার মাঝে মেয়েদের নতুন করে আবিষ্কার করতে থাকি আমি। কথা বলার সময় মনা অকারনে খিলখিল করে হেসে ওঠে। কোন ছেলেবন্ধু হলে আমি নিশ্চিত বিরক্ত হতাম কিন্তু মনার এরকম অসংযত,অকারন হাসি আমার ভালো লাগে,এক ধরনের ভাললাগা তৈরী হতে থাকে মনার জন্য ,আগে যা কখনও হয়নি কোনো মেয়ের জন্য। আমি বুঝতে পারি আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি,কিন্তু এ দুর্বলতা আমি ঠেকাতে পারিনা।আমার খারাপ লাগতে থাকে। আমার অবস্থাগত কারনে দুর্বল হওয়ায় আমার খারাপ লাগতে থাকে,খারাপ লাগতে থাকে ছাত্রীর প্রতি দুর্বল হওয়াতেও। আমি নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকি।

/p>

বারোদিন পড়ানো হয়ে গেলে মনা আমাকে সাদা খামটি দেয়। বলে ভাইয়া আম্মু দিয়েছে। এর আগে আমি কখনো পড়ানো বাবদ খামভর্তি টাকা নেইনি। একটু বিব্রতবোধ হয় আমার। চট করে খামটি সামনের পকেটে রাখি।মনাকে আর পড়ানো হবেনা,হয়ত দেখাও হবেনা কখনও ভাবনাটা মাথায় চেপে থাকে । মনটা ভারী হয়ে ওঠে আমার। যন্ত্রের মত পড়াই আমি,কোন গল্প হয়ে ওঠেনা সেদিন। পড়ানো হয়ে গেলে আমি বলি মনা আজকে তাহলে যাই,ভালোভাবে পরীক্ষা দিও। মনা বলে, আচ্ছা। আমি মনার কিছু বলার জন্য বৃথা অপেক্ষা করতে থাকি। মনা কিছু বলেনা,চুপ করে থাকে,ফোন আসে ফোন ধরে কথা বলতে থাকে। আমি বসেই থাকি,কেন জানি যেতে ইচ্ছে করেনা। মনা ফোন কেটে দিয়ে আমার দিকে তাকায়,আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। আমি বসে আছি কেন মনার তো কিছু বলার কথা নয়,কেউ একজন ভিতে থেকে আমাকে নাড়া দেয়।আমাকে উঠতেই হয়। আমি বলি ঠিক আছে গেলাম। দরজার দিকে পা বাড়াই আমি,মনাও দেখি দরজা পর্যন্ত আসে।আমার বুকের ভিতরটায় ধক করে ওঠে,আমি দরজায় গিয়ে দাড়াই। মনা কি কিছু বলবে,আশান্বিত আমি চেয়ে দেখি মনার দিকে।মনা বলে ভাইয়া দোয়া করবেন,চান্স পেলে খাওয়াব।আমি বলি হ্যাঁ দোয়াতো করবই। দরজার সামনের লনটাতে পা বাড়াই আমি।

মনাদের বাড়ী থেকে এই একটি খাম নিয়ে আমি ফিরে আসি। মনার সাথে আমার আর কখনও দেখা হয়নি। এই পৃথিবীতে কেইবা কাউকে মনে রাখে!মাঝে মাঝে আমি খামটা বের করে দেখতাম। মনার কথা চিন্তা করতাম,কেমন আছে বোকা মেয়েটা! আমি হয়ত তখনও বুঝিনি মনার কাছ থেকে এই একটিমাত্র খামের বেশী আর কিছু পাওয়ার যোগ্যতা আমার ছিল না।

বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০০৮

মোফাকখারুল

সপ্তাহে পাঁচদিন সকাল আটটার সময় আমার মেজাজ খারাপ থাকে।কারন ঐ পাঁচদিন আটটায় ক্লাস থাকে।রাত চারটা-পাঁচটা পর্যন্ত জেগে থেকে কেইবা আটটায় ক্লাস নামক জিনিসটা করতে যায়।তারপরেও যাই,ভাগ্যের ফেরে যেতে হয়।পিছনের বেন্চে বসে বই সামনে নিয়ে পড়ার ভান ধরে ঝিমুতে থাকি।সেদিনও সকালে ঝিমুচ্ছিলাম,মনুষ্যকন্ঠে আমার নাম শুনে তন্দ্রাবিলোপ ঘটে।"এই কায়েস ঘুমাচ্ছিল"।আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।কোন শালা আবার সাতসকালে ডাকাডাকি করে।আমি চোঁখ মেলে চাই,মোফাকখারুল ডাকছে।আমি মোফাকখারুলকে দেখে অবাক হই।এই ফাষ্ট বেন্চার এখানে কি করছে। মোফাকখারুল করুনামাখা কন্ঠে বলে কায়েস আমিতো শেষ।আমি মোফাকখারুলের শেষ হওয়ার কোন কারন খুঁজে পাইনা।

যুগপৎভদ্র এবং বলদ(!) ছেলে মোফাকখারুল।সকালে বাপের গাড়ীতে চেপে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে আসে,প্রথম বেন্চে বসে আটটা থেকে একটা পর্যন্ত মাছিমাড়া কেরানীর মত স্যারদের লেকচার তোলে,ল্যাব থাকলে আড়াইটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে ল্যাব করে,মাঝের এক-দেড় ঘন্টা বাসা থেকে আনা কাটলেট আর সেন্ডুইচ খেয়ে লাইব্রেরীতে পড়াশুনা করে আর ক্লাসটেষ্টে অনবরত বিশে বিশ পেতে থাকে।ক্লাসের সুন্দরী মেয়েরা মোফাকখারুলের সাথে ন্যাকামি করে,একটু পড়াটা বুঝাওনা মোফাকখারুল। আমার মেজাজটা খারাপ হয়।শালা মর তুই!কিন্তু আমি জানি এ একটা আধা না পুরা বলদ,দুনিয়াদারী সম্বন্ধে এর কোন আইডিয়া নাই।কোথা থেকে একদিন শুনে এসেছে নীল ছবি নামে একধরনের ছবি আছে তারপর দু-তিনদিন আমাকে জ্বালিয়েছে নীল ছবি কি,নীল ছবি কি বলে।আমি বলিনি ,বলেছি আছে না কত ধরনের ছবি আছে দুনিয়ায়,এটা মনে হয় কোন বিশেষ দেশের তৈরি ছবি।বেটা বিশ্বাস করেছে,বলদ না!বিশ্বাস তো করবেই।তো মোফাকখারুলের সমস্যার কথা শুনে আমারও কিছুটা কৌতুহলের উদ্রেক হয়।আমি বলি ক্যান কি হইছে।সে আবার বলে কায়েস আমি তো শেষ,মানুষে আমাকে খারাপ ভাবছে।আমি বলি আরে খুলে বল তো কি হইছে।সে বলে নীলা নাকি তাকে বলেছে সে নাকি খুব অশ্লীল।তার সাথে আর কথা বলবে না।
-ক্যানো তুমি তাকে কি বলছ
-আরে আমি বলেছি তুমি কি পেন্টিটা পড়ছ
আমি ভাবি কাম সারছে আজ।আমি জানতে চাই আর কি সে বলছে।
- আর কি বলব।এই কথা বলার পরেই তো সে মুখ লাল করে ফেলল।আমি বললাম আমি গতকাল পেন্টি পড়েছি।খুব ভালো লাগছে পেন্টিটা পড়ে।অনেক জিনিসই তো পড়লাম,কিন্তু এটার মত ভাল লাগলো না কিছু।আমি বললাম পেন্টির কথা বলা তোমার ঠিক হয়নি।ও আকাশ থেকে পড়ে।বলে
-আরে কত কিছুই তো আমরা সংক্ষেপে বলি।ডাটা কমুনিকেশন কোর্সটাকে গতবার ডাটাকম বললামনা,প্যাটার্ন রিকগনিকেশনকেও তো পিআর বলি।আমি বলি হ্যাঁ ঠিক আছে,কিন্তু,,,,।ও আমার কথা শেষ করতে দেয়না।
-ডাটা কমুনিকেশনকে ডাটাকম,প্যাটার্ন রিকগনিকেশনকে পিআর বললে সমস্যা যদি না থাকে তাহলে মাইক্রোপ্রসেসর কোর্সের ইন্টেলের পেন্টিয়াম মাইক্রোপ্রসেসরকে পেন্টি বলতে সমস্যা কোথায়।স্যারই তো একদিন বলেছিল।

আমি বিষম খাই।মাছি মারা কেরানী ছাত্র হওয়ার বিপদ বুঝতে পারি।মোফাকখারুলকে আসল কথা বলিনা।শালা মেয়েদের সাথে দহরম-মহরম,নে এবার বোঝ ঠেলা।এবার যদি মেয়েদের ন্যাকামিটা কমে।আমি মিটিমিটি হেসে আবার ঝিমুতে থাকি।

চোর

মফস্বল শহরে বাসা পাল্টানো খুবই ঝামেলার কাজ।ওখানে ঢাকার মত প্যাক এন্ড মুভ জাতীয় সংস্থা থাকেনা।তবু কাজটা প্রায়ই করতে হয়।বাবা সরকারী চাকুরী করেন,বদলীর চাকুরি।গড়ে তিন বছরে একবার বদলী।আমরা দেশের বাড়ী থেকে দু-চারজন লোকজন আনি জিনিসপত্র আনা নেওয়া করার জন্য।একবার বদলীর পর নতুন বাসায় আমার ছোট্ট ওয়াকম্যানটা খুঁজে পাইনা।আম্মাকে বলি ।আম্মা দোষ দেন দেশ থেকে আসা লোকগুলোর।"বুঝিস না চোর-ছ্যাচ্চর এর জাত ,যা চোখে পড়ে তাই নিয়ে যায়।আমিওতো দরজার একটা সাদা পর্দা পাচ্ছিনা।" কাজের মেয়েটা বলে "ভাইজান এরা চুর,আমরার চেনটা নিছে,বিচরাইতেছি,পাইত্যাছি না,"।আব্বা অফিস থেকে ফিরলে আম্মা বিচার দেন কি লোক নিয়া আসছ,বাসার নানান জিনিস সরাইছে।আব্বা বলেন দেশের বাড়ী থেকেই তো লোক নিয়া আসলাম,এরা চুরি করলে কি করবা।আম্মা গজরাতে থাকেন।আমি ভাবি শালা চোরের দেশ,সব শালা চোর।চোরের চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করে রাতে ঘুমাতে যাই।

পরদিন সকালে নতুন কেনা আলমিরাটা খুলতে গিয়ে ওয়াকম্যান আর দরজার সাদা পর্দাটা পাওয়া যায়।

জায়গা করে নিতে হবে

যারা আমাকে শিখিয়েছিল এতদিন
একটি কথাই বলেছিল তারা বারবার
আমার নিজস্ব কোন জায়গা নেই
জায়গা করে নিতে হবে
পিঁপড়ার সারিতে যেমন করে জায়গা করে নেয় পিঁপড়ারা।

কিছু কিছু লোক আছে
জায়গা করা যাদের হয়ে ওঠে না
যাদের জায়গাটাতেই জায়গা করে নেয় কেউ কেউ
নিঃসঙ্গ পিঁপড়াদের মতই যেন তারা
মাঝে মাঝে আমিও এইসব লোকেদের দলে পড়ে যাই ।

সোমবার, ৭ এপ্রিল, ২০০৮

তুমি বিষয়ক

১।ফুটন্ত কলি স্পন্দিত হচ্ছে নির্বিঘ্নে
লাভ কার গোলাপ গাছ তোমার না ভ্রমরার ?

চাক ভেঙে মৌ মৌ করে উঠছে মধু
লাভ হচ্ছে কার জারুল গাছ তোমার না মৌমাছির ?

তুমি দুলে উঠছ অক্লেশে
সর্বাঙ্গ শরীর থেকে মুছে ফেলছো অন্ধকার
চিবুক ,স্তনে অবিরাম চাষ হচ্ছে গোলাপ
বসরার সুগন্ধি লাল গোলাপ
বলে দেবে একবার লাভ হবে কার
আমার না তোমার বর্বর স্বামীর ?

২। তুমিই তো কেড়ে নিয়েছিলে সব
মধু ,পড়তে পড়তে শরীরে ছড়ানো
দেখ তাই মৌমাছিরা বড় অসহায়
মধু ভেবে মানব রাবারে হুল ফোটায়।

রবিবার, ৬ এপ্রিল, ২০০৮

মানিব্যাগ,আমার মানিব্যাগ

একটি মানিব্যাগের স্বপ্ন আমার ছোটবেলা থেকেই । বাবা-চাচাকে মানিব্যাগ পকেটে করে সগর্বে হাটতে দেখে আমারও একটি মানিব্যাগের গর্বিত মালিক হওয়ার ইচ্ছে জাগে । চাচাকে দেখতাম মানিব্যাগের মধ্যে দুনিয়ার যাবতীয় কাগজপত্র নিয়ে ঘুরতেন । জানতে চাইলে বলতেন বড় হ বুঝবি।হ্যাঁ বড় হওয়ার আগে যে মানিব্যাগ কেনার টাকা পওয়া যাবে না তা আমি জানতাম । তাই প্রথমদিকে মানিব্যাগ দেখেই দর্শনতৃপ্তি লাভ করতে হত,কিন্তু আত্বতৃপ্তি পেতাম না। না। বাসায় আত্বীয়স্বজন বেড়তে আসলে আমি প্রাথমিক আলোচনার পরেই তাদের মানিব্যাগ দেখতে চাইতাম। তাদের অধিকাংশই বিরক্ত হত , মুখে বলত না কিছু কিন্তু বাসায় ঝাড়িটা খেতাম ঠিকই।

ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় প্রবলভাবে মানিব্যাগপ্রাপ্তির আশা চেপে বসল আমার মনে। পণ করলাম যে করেই হোক এ জিনিস আমাকে একটা অধিকার করতেই হবে। কিন্তু চাইলেই তো সব হয় না তার জন্য দরকার উপযুক্ত কার্যকরন।চেষ্টার কমতি ছিল না আমার। একটি মানিব্যাগের জন্য আমি নানানভাবে টাকাপয়সা নয়-ছয় শুরু করতে লাগলাম। আম্মা অফিস থেকে ফিরলেই অপেক্ষা করতাম কখন রান্নাঘরে যাবেন আর আমি আলগোছে আলমারীতে রাখা ওনার অফিসব্যাগ থেকে এক-দুইটা একটাকার পয়সা সরিয়ে ফেলব
না। আব্বার জন্য অপেক্ষা করতাম দুপুরে,কখন দুপুরের ভাত খেয়ে আব্বা ঘুমাবেন আর আমি হ্যাংগারে রাখা শার্ট থেকে দু-একটা টাকা সরাব। এভাবে নানান কাটখড় পুড়িয়ে চল্লিশ টাকার বিনিময়ে এক হাটের দিনে মফস্বলের বাজার থেকে একটি মানিব্যাগ কিনলাম,গর্বিত মালিক হলাম একটি মানিব্যাগের। ছোট চাচার মত অজস্র কাগজ ভরিয়ে পেট মোটা করে ফেললাম মানিব্যাগের। স্কুলে গিয়ে পকেটে মানিব্যাগ নিয়ে বুক ফুলিয়ে হাটি,কারনে-অকারনে অন্যদের সামনে বের করে উল্টেপাল্টে দেখি।বন্ধুদের বলি দেখ,মানিব্যাগ দেখ,আমার,তোর আছে এরকম।বন্ধুরা ঈর্ষায় জ্বলে,ওরাও মানিব্যাগের স্বপ্ন দেখা শুরু করে। কিন্তু সুখের দিন আমার বেশিদিন স্থায়ী হয়না।এক ছুটির দিনে দুপুরে কাপড় কাচতে গিয়ে আম্মা দেখে ফেলেন আমার গোপন সম্পত্তি। কখন,কোথায়,কিভাবে পেয়েছি তা নিয়ে জেরা চলতে থাকে।বলাতো যায়না চুরি করা টাকা দিয়ে মানিব্যাগ কিনেছি তাই নানান সময়ে নানান কথা বলতে হয়।ধোপে টেকেনা আমার যুক্তি।সীজ হয়ে যায় আমার সাধের মানিব্যাগ। কিন্তু তবুও আমার একটি মানিব্যাগের স্বপ্ন শেষ হয়না। বৈধভাবে আমার প্রথম মানিব্যাগ কেনা হয় এস,এস,সি পাশ করে মফস্বল থেকে জেলা শহরে কলেজে ভর্তি হওয়ার সময়। এবার আর কাউকে বলতে হয়না,বাসা থেকেই টাকা দিয়ে দেয় মানিব্যাগ কেনার জন্য। পয়ষট্রি টাকা দিয়ে কালো রঙের মানিব্যাগ কিনি একটি। ছোটখাট একটা ভল্ট হিসেবে ব্যবহার শুরু করি একে। বাসা থেকে পাঠানো আম্মার চিঠি,সময়ে অসময়ে লেখা ছড়া-কবিতা,নানান ধরনের দলিল-দস্তাবেজ ভরে ফেলি এতে। ধীরে ধীরে আমার ব্যক্তিগত এনসাইক্লোপেডিয়া হয়ে ওঠেমানিব্যাগটি। ধীরে ধীরে আমার অস্তিস্তের সাথে মিশে যেতে থাকে মানিব্যাগটি। আমাকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয় এর অস্তিস্ত রক্ষায়। মানিব্যাগ রাখার জন্য নতুন বানানো প্যান্টগুলোতে দর্জির কাছে গিয়ে পিছনের পকেটের উপরে বোতামসহ ঢাকনা বানিয়ে আনি , মেসে ঘুমানোর সময় বালিশের নিচে রাখি, বাসে বা ভীড়ের মধ্যে চলাচলের সময় মাঝে মাঝে হাত রাখি পকেটে, বুঝতে চেষ্টা করি ঠিক আছে তো সব। এভাবে মানিব্যাগটির সাথে আত্বীয়তা করে সময় গড়িয়ে যায় আমার। কিন্তু শেষরক্ষা শেষ পর্যন্ত হয়না। এইচ,এস,সি পাশের পর ঢাকায় এসে মানিব্যাগটি বেহাত হয়ে যায়। মফস্বল থেকে সদ্য পাশ করা বোকা এই আমি জানতাম না এই শহরে দিনদুপুরে লোকজন অন্যের জিনিসপত্রে চোঁখ দেয়,ছিনিয়ে নেয় জোর করে। একান্ত বন্ধুর মত সবসময় সাথে থাকা মানিব্যাগটি হারিয়ে আমি যেন র্নিবান্ধব হয়ে পড়ি, মানিব্যাগটিতে থাকা জিনিসপত্রগুলোর জন্য হয়ে পড়ি কাতর । সর্বোপরি মানিব্যাগটির শোকে কাতর আমাকে আরো কয়েকমাস মানিব্যাগবিহীন থাকতে হয়।

বু্য়েটে ভর্তি হই।স্বাভাবিকভাবে জীবন চলতে থাকে,একটু ভালোভাবে থাকার জন্য টিউশনি ধরি। মাসশেষে অনেকগুলো টাকা ওঠে হাতে। বন্ধু-বান্ধব অনেকে বলে পুরানো মোবাইল ব্যবহার করিস একটা নতুন মডেলের মোবাইল নে। আমি মোবাইল কেনার জন্য মার্কেটে যাই কিন্তু ফিরে আসি মেন্জ ক্লাব থেকে পনেরস টাকা দিয়ে মানিব্যাগ কিনে। বন্ধুরা যারা আমার মানিব্যাগের ঘটনাবলী জানে তারা হাসে,বলে আবার মানিব্যাগ। অনেকে বলে শুধু টাকা রাখার জন্য এত টাকার মানিব্যাগ,অপচয়,পুরোটাই অপচয়। ওরাতো জানে না মানিব্যাগ শুধু আমার কাছে একটি অর্থথলি নয়,এটা আমার ভল্ট,আমার বন্ধু। আবার আমার মানিব্যাগের মোটা হতে শুরু করে।স্থান পেতে শুরু করে পত্র থেকে শুরু করে সদ্য কেনা ঘড়ির দোকেনের ম্যামো পর্যন্ত । কিন্তু এবারও শেষরক্ষা হয়না। এক ফাল্গুনের দুপুরে ল্যাব থেকে ফিরে এসে যখন প্রবলভাবে ঘুমাই তখন হলে আমার রুম থেকে চুরি হয়ে যায় মানিব্যাগটি। এবার আমাকে অনেক যন্ত্রনা পোহাতে হয়। হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড হারানোতে থানায় জিডি করতে হয়,ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড হারানোতে পাঁচশত টাকা দিয়ে নতুন করে তুলতে হয় ক্রেডিট কার্ড । আমার আফসোস বাড়ে ইস! আরএকটু যত্ন করে যদি রাখতাম মানিব্যাগটি।আফসোস করতে করতে আমি আবারো একটি নতুন মানিব্যাগ কেনার স্বপ্ন দেখি।

খুন হয়ে পড়ে রয়েছি রাস্তায়

অনেকদিন হল আমি খুন হয়ে পড়ে আছি রাস্তায়
বর্ষার তুমুল ঝড়ে উড়ে যাচ্ছে আমার দেহাবশেষ
যে স্বচ্ছ আকাশকে এতদিন ভালোবাসতাম
সেই আজ মেঘ হয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে আমাকে।

খুন শুনলে তোমরা কেঁপে ওঠো
খুনি ধরা পড়ুক, বিচার হোক এই তোমাদের প্রত্যাশা
আশ্চর্য , আমি যে খুন হয়ে পড়ে আছি জানছে না কেউ,
ছাপছেনা খবরের কাগজ হইচই হচ্ছে না কোথাও
কথা হচ্ছেনা মোড়ের চায়ের টেবিলে
তবে কি মৃত আমি জীবিত আমির মতই অপাংক্তেয় ?

কে আমাকে হত্যা করল
মানুষ থেকে কেড়ে নিল মনুষ্যত্ব কুকুর বানিয়ে ফেলে রাখল রাস্তায়
একবারও জানতে চাইল না কেউ
বর্ষার মোহন দুপুরে অপেক্ষায় থাকলাম
মর্গের ভ্যানের অপেক্ষায় থাকলাম।

শনিবার, ৫ এপ্রিল, ২০০৮

নগরপিতার কাছে আমাদের আবেদন

শ্রদ্ধেয় নগরপিতা,
এই শহরে আমরা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছি
আমরা আমাদের অপসারণ চাই ।

চারদিকে নীরব বিপ্লবের আস্ফালন আজ
পোশাকে-আশাকে, শিল্প -সংস্কৃতিতে ,রাজনীতি - বলনীতিতে
আমরা খাপ খাওয়ানোরও অযোগ্য বড়ই।

রুপালি পর্দায় সোনালী শরীর
ছোট পর্দায় চল্লিশোর্ধ মহিলার যৌবন
রিকশারোহী তরুণ- তরুণীর চুম্বন
তরুণ কবির খাদ্য গাজাঁ
আর্ট ফিল্মের কামজ শরীর
ক্রমাগত শরীরের সাথে সেটে যাওয়া পোষাক
প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবিদের বক্তৃতা বিক্রি করে কেনা খাবার
আমরা আর সইতে পারছি না নগরপিতা।

আইন করে খাওয়া বন্ধ করে করলেন তামাকের ধোঁয়া
অথচ শহরময় ধোঁয়ার গতি হল না কোন।
নগরপিতা আমরা পরাজিত
নব্য যাজকেরা নষ্ট করেছে আমাদের ধর্ম
সাধের সমাজতন্ত্র- সেটাও পরাজিত কম্যূনিষ্টদের কাছে
সত্যিই খাপ খাওয়াতে পারছি না আর
আমরা আমাদের অপসারণ চাই।

শুক্রবার, ৪ এপ্রিল, ২০০৮

সবুজ খাম

প্রতিদিন সকালের রোদ মুখে আসার পর আমার ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। কিন্তু আজই প্রথম এর ব্যতিক্রম হয়ে গেল। আর মাত্র মাস খানেক পরই আমার ফোর্থ ইয়ার অনার্স ফাইনাল। সারাবছর বলতে গেলে কোন পড়াশোনাই হয় না। তাই পরীক্ষার আগের এই একমাসই ভরসা। কয়েক দিন যাবত অনেক রাত জেগে পড়তে হচ্ছে। সকালের দিকে এমন ঘুম আসল যে যখন বিছানা থেকে উঠলাম তখন বারোটা পেরিয়ে গেছে। সকালের ক্লাসটা মিস হয়ে গেল। অবশ্য ক্লাস করে যে খুব একটা লাভ হয় তা নয়। পরীক্ষার আগে গুটিকয়েক প্রথাগত প্রশ্ন পড়েই যদি বেশ চলে যায়, ক্লাস করেই তবে কী লাভ। তবুও আমি যে নিয়মিত ক্লাসে যাই সেটার জন্য একটা কারণ আছে। সেটা না হয় একটু পড়ে বলা যাবে।

হলের সরু প্যাসেজ দিয়ে বাথরুমের দিকে যাচ্ছি। পাশের রুমের জালাল জিজ্ঞেস করল, মামু কি খবর, গল্পটা পড়ছ তো?
জালাল আমার ভাগ্নেগোছের কেই নয়। তবুও সে আমাকে ও নামেই ডাকে, যদিও এ বিষয়ে আমার যথেষ্ট আপত্তি আছে। এজন্যই ভাগ্নের আবদার হিসেবে আমাকে তার লেখা কিছু অখাদ্য গল্প-কবিতা পড়তে দেয়। আমি অবশ্য গল্প-কবিতার তেমন কিছু জানি না। তারপরও অখাদ্য বললাম, কারণ আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি জালালের গল্প-কবিতার একমাত্র পাঠক আমিই এবং সে শত চেষ্টা করেও এ জিনিস আর কাউকে গেলাতে পারেনি। আমি বললাম, বেশ ভালই হয়েছে, চালিয়ে যাও। জালালের চোখমুখ দেখে মনে হলো সে বেশ অনুপ্রাণিত হয়েছে অনেকটা।
সকালের নাস্তাটা করতে হলো নুরুর দোকান থেকে। অবশ্য এটাকে সাকলের নাস্তা বলা যায় কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। ঘড়িতে দেখলাম প্রায় একটা বাজে। দুপুরে একটা ক্লাস আছে, যেতে পারলে নিম্মির মুখটা অন্তত একবার দেখা যেত। এই মেয়েটাকে আমি গত পাঁচ বছর ধরে ভালবেসে আসছি, কিন্তু কখনো বলতে পারিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব দুর্বল মানুষ। এতটাই দুর্বল যে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরের বছরেই যখন আমার বাবাকে ছেড়ে মা দ্বিতীয় বিয়ে করলেন তখন তার প্রতি রাগ করতে পারলাম না। সুতরাং আমি যে নিম্মিকে আগামী কয়েক মাসেও বলতে পারব না, আমি তোমাকে ভালোবাসি, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকবে না। হয়ত বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়ে স্বাভাবিকভাবেই বিয়ে-শাদী করে জীবন যাপন করব। তারপর একদিন হঠাৎ রাস্তায় তার সাথে দেখা হলে মনে মনে ভাববো এই মেয়েকে আমি একসময় ভালোবাসতাম, সে কি কখনও সেটা জানার চেষ্টা করেছিল। এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আতিফ ইকবাল একটা জলন্ত- সিগারেটকে দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করতে লাগলাম।

নুরুর নাস্তা এসে পড়েছে। নাস্তা বলতে একটা পেটকাটা রুটির ভেতরে ডিমপোচ। শুনলে হয়তো অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবে না যে আমি এই একই নাস্তা গত চার বছর ধরে সকাল থেকে খেয়ে আসছি। ব্যাপারটা এতটাই একঘেয়ে হয়ে এসেছে যে এই একঘেয়েমোটাকে আর একঘেয়েমো বলে মনে হতে চায় না। শহীদুল্লাহ হলের ছাত্রদল সভাপতি সেলিম এসে আমার পাশে বসল। রাজনীতি বিষয়ক ব্যাপারগুলোতে আমি মোটামুটি নিরপেক্ষ থাকার ভান করি এবং চেষ্টা করে যাই যাতে সব নেতার মত জুগিয়ে চলা যায়। সেলিম হলের ছিটের ব্যাপারে কি যেন সব জটিল হিসাব বোঝাতে চাইল তার আগাগোড়া কিছুই বোঝা গেল না। তবে যেটুকু বোঝা গেল তাতে এটা স্পস্ট হওয়া গেল যে, আগামী বছর থেকে যাতে বিরোধী কোন দলের ভর্তিকৃত নতুন ছাত্র হলের ছিটে ঢুকতে না পারে সে ব্যাপারে তারা দেখবে। সেলিমকে এক কাপ চা খাইয়ে আমাকে নিস্তার পেতে হলো। দুপুর আড়াইটায় শহীদুল্লাহ হলের গেট পেরিয়ে বিজ্ঞান ভবনের দিকে রওয়ানা হলাম। নিম্মির টয়োটা করলাটাও এসে পড়েছে। গেটের সামনে বিশ্বজিৎ দাঁড়িয়ে আমড়া খাচ্ছে। আমাকে দেখে আমড়ার দুটো ফাল এগিয়ে দিল। শালীর বেসটা দেখছস, জোশ - একটা লোভী ভঙ্গিতে কথাটা বলল বিশ্বজিৎ। এই বেসটা জিনিসটা যে কি সেটা আমি বেশ ভালভাবেই বুঝি, অন্য সময় হলে হয়ত এরসাথে আমিও দু’একটা জিনিস যোগ করতাম, কিন্তু নিম্মির টয়োটা করোলার ড্রাইভারকে দেখে নিবৃত্ত হলাম।

নিম্মির সাথে আমার পরিচয় হবার ঘটনা যতটা স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল ততটা স্বাভাবিকভাবে হয়নি। মফস্বলের একটা কলেজ থেকে পাশ করে সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল পরিবেশে এসেছি। প্রথম দিনে বিজ্ঞান ভবন খুঁজতে এসে অন্য বিল্ডিং-এ ঢুকে পড়লাম। এদিক-ওদিক ক্লাসরুম খুঁজছি, এমন সময় একটা মেয়ে এসে বিজ্ঞান ভবনটা কোনদিকে হবে জানতে চাইল। চিন্তা করে দেখলাম যদি বলি জানি না তবে সেটা প্রেস্টিজের জন্য খুব একটা সুবিধা হবে না। নিরুপায় হয়ে পার্শ্বের একটা বিল্ডিং দেখিয়ে দিলাম। ক্লাস শেষে বেরিয়ে আসছি এমন সময় দেখলাম মেয়েটিও আমাদের সাথে বেরিয়ে আসছে। তবে আমাকে দেখে তার বান্ধবীকে যে কথাটা বলল সেটা মোটেও শ্রুতিকর কিছু হল না। শুনতে পারলাম বান্ধবীকে বলছে, আমাদের সাথে তো দেখছি একটা গাধাও ভর্তি হয়েছে। ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল এভাবে এবং আমি নিশ্চিত নিম্মি আজ পর্যন- আমাকে গাধার চেয়ে উচ্চতর কোন প্রাণী মনে করে না। বিশ্বজিৎ এর সাথে কথা বলতে বলতে ক্লাসের মিনিট পনের খেয়ে ফেললাম। বাকী তিরশি-চল্লিশ মিনিট ক্লাস করব কিনা ভাবছি, এমন সময় দেখলাম বাক্কু সুমন আমায় দেখে এগিয়ে আসছে। ভাবলাম, যাক আজ আর ক্লাস করতে হবে না। সামনের দিকে কিছুটা ঝুকে হাটে বলে একে আমরা বাক্কু নামে ডাকি। গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ হলো নামকরা আতেল। বাংলাদেশে তো অবশ্যই, পৃথিবীতে সম্ভবত খুব কম জিনিসই আছে যেটা সে জানে না। অবশ্য সে জানাটা যে কতখানি বিশুদ্ধ সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তার মুখোমুখি হলেই সে একটা বিষয় নিয়ে লেকচার দেয়া শুরু করবে, যেটার স্থায়ীত্ব কম করে হলেও মিনিট বিশেক হবে। আমি বাক্কু সুমনকে কাটানোর জন্য করিডরে লুকিয়ে পড়লাম। ক্লাস শেষে নিম্মি বের হয়ে আসল। আমি কাধে ঝোলানো ব্যাগ একটা নোট বের করে নিম্মিও দিকে এগিয়ে দিলাম। নিম্মি তোমার ক্লাস নোট। কাজ শেষ? শেষ না, শেষের শুরু। মানে? মানে কপি শেষ পড়া বাকী। ওহ্‌, তাই বল। বাসায় যাচ্ছ? বাসায়ই যাচ্ছিলাম, কিন্তু রফিকটা জোড় করে ধরেছে। বলাকায় কী জানি একটা নতুন ছবি এসেছে, ওরা সবাই মিলে দেখবে। আমারও নাকি টিকেট কেটেছে। ওদের সাথে যেতে হচ্ছে। ও, আচ্ছা। নিম্মির সাথে কথাবার্তা মোটামুটি এরকম একটা গতানুগতিক রূপ নিয়েই এগিয়ে যায় প্রতিদিন। অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদের সাথে যে রকম ঘনিষ্টতা আমার সাথে, যেন ততটাই দূরত্ব নিম্মির। আমাদের কথাবার্তা মূলত দু’চারটা নোট আদান প্রদান বিষয়কই হয়। ছাত্র হিসেবে আমাকে অনেকেই ভালো কিংবা অনেকে ব্রিলিয়ান্ট বলে থাকে। তবে ভালো ছাত্রের যেরকম বৈশিষ্ট্য থাকা উচিৎ সেরকম কিছু আমার কাছে নেই। তবে একটা জিনিস যেটা আছে সেটা হলো স্মরণশক্তি। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার আগে একমাস ঘরের দরজা বন্ধ করে পড়া মুখস- করি আর পরীক্ষার হলে ঢেলে দিয়ে আসি। আশ্চর্য হয়ে আমি লক্ষ্য করেছি, এতেই আমি অবলীলায় ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড, থার্ড কিংবা একবার তো ফার্স্টই হয়ে গেলাম। সুতরাং ছাত্রছাত্রীদের সাথে আমার যে ঘনিষ্টতা আছে সেটা অনেকটা নোটের সূত্র ধরেই। এই পাঁচ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে কেউ আজ পর্যন্ত- আমাকে বলেনি, দোস্ত, চল একটা ছবি দেখে আসি কিংবা দোস্ত- রূপার অথবা নিলার জন্য একটা চিঠি লিখে দে। নিম্মির সাথে আমার যে সামান্য কথাবার্তা হয় সেটা নোটের মাধ্যমেই। কতবার মনে হয়েছে নোটের ভিতরে লাল কালিতে লিখে দিই, নিম্মি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু কখনই লেখা হয়নি, সম্ভবত কোনদিন হবেও না। কতবার মনে হয়েছে নোট নেয়ার সময় একবার নিম্মির হাতটা ছুঁয়ে দেখব কিন্তু আমি দুর্বল মানুষ, সুতরাং সে সৌভাগ্য আমার কখনই হয়নি। তবুও মনে মনে ভাবতাম থাক, যাকে ভালোবাসি তাকে তো প্রতিদিন একবার অন্তত দেখতে পারছি। ক্লাস, প্র্যাকটিকাল কোনটাই না করে আমি ধানমন্ডির দিকে রওয়ানা হলাম। কাল আমার জন্মদিন। চার বছর হলো জন্মদিনের একদিন আগে প্রতিবছর আমি ধানমন্ডিতে একবার ঘুরে আসি। এখানে আমার মা তার স্বামীর সাথে বাস করেন। প্রতি বছর এই দিনে আমার মনে হয় তাকে গিয়ে একবার বলি, আমার জানতে ইচ্ছা করে আমার বাবা কে? আমার জন্ম নিয়ে আমার বাবার এক ধরণের সন্দেহ ছিল। আমি জন্মানোর আগ পর্যন্ত- এই লোকটা নাকি জানতো তার দ্বারা কখনও সন্তান উৎপাদন সম্ভব নয়। সুতরাং আমার পঁচিশ বছরের জীবনে আমি কখনই আমার বাবা-মাকে হাসি মুখে কথা বলতে দেখিনি। অবশ্য আমি যে আমার মাকে এই প্রশ্ন করতে যাচ্ছি, আমি জানি এটা স্রেফ যাওয়ার ইচ্ছা বলে যাওয়া। আমার দ্বারা কখনই মাকে এরকম কথা বলা সম্ভব নয়। গত চার বছরের মতো এবারও হয়ত আমাকে বাড়ীর গেট থেকেই ফিরে আসতে হবে। তবুও যাওয়া বলেই যাচ্ছি।
ফোর্থ ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষাটা বেশ ভালই হল। সম্ভবত এবারও ফার্স্ট ক্লাস থাকবে। সামনে অনেক অবসর। আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে আমি হলেই পড়ে আছি। পরীক্ষা শেষে সবাই বাড়ীতে চলে গেছে, হল অনেকটা ফাঁকা। দু’একজন ছাত্রকে পড়াই আর পাবালিক লাইব্রেরীতে পড়ি। বিকেলটায় অনেক সময় নিম্মির বাড়ীর গেট থেকে বা আমার মায়ের বাড়ীর গেট থেকে ঘুরে আসি।

চৈত্রের এক দুপুর। সকাল থেকে না খেয়ে বিছানায় পড়ে আছি। হলের ডাইনিং বন্ধ, বাইরে যেতে ইচ্ছা করছে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। একটা লাল করোলা শহীদুল্লাহ হলের গেটে থামল। একটা লাল শাড়ী পরা সুন্দর মেয়ে গাড়ি থেকে নামল। মেয়েটাকে একবার দেখে অন্যদিকে তাকানো যায় না। তবুও আমি চেষ্টা করে দৃষ্টি বড়ই গাছের ডালে বসা কাকের গায়ে ফেললাম। দুটো কাক একটা ডালে বসে আছে। ওরা কী স্বামী-স্ত্রী নাকি প্রেমিক-প্রেমিকা। কা কা করে একটা কাক উড়ে গেল, সাথে সাথে অন্য কাকটাও তার পিছু নিল। দরজায় ঠক্‌ ঠক্‌ করে করার শব্দ হচ্ছে। উঠে গিয়ে দরজা খোলার ইচ্ছে হচ্ছে না। বললাম কে, কাকে চান? এখানে কি আতিক ইকবাল থাকেন? - মেয়ে মানুষের কন্ঠ শুনে উঠতেই হল। দরজা খুলে দেখি একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা সবুজ খাম। মেয়েটা যে কে সেটা চেনার জন্য আমাকে একটু কষ্ট করতে হলো। পরে বুঝলাম এটা নিম্মিই। একটা মেয়ে সেলোয়ার থেকে শাড়ী পড়লে যে পুরো পাল্টে যায় সেটা প্রথম বুঝলাম নিম্মিকে লাল শাড়ী পড়তে দেখে।
আরে তুমি - আমি হন্তদন্ত হয়ে বললাম। নিম্মি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। একটা কাঠের চেয়ারে বসে হেসে হেসে বলতে লাগল, তুমি তো কোন খোঁজ নাও না, তাই আমাকেই আসতে হলো। আমি কী বলব বুঝতে না পেরে মাথা চুলকাতে লাগলাম। নিম্মি একটা সবুজ খাম আমার দিকে এগিয়ে দিলো। খামটা দেখেই আমার বুঝা উচিৎ ছিল এটা কীসের। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না, বুঝার জন্য খামটা খুলতে হলো। নিম্মির বিয়ে, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। আমি গালদুটো প্রসারিত করে হাসার চেষ্টা করতে লাগলাম যেন এসময় হাসাই উচিৎ। কিছু বলার মতো খুঁজে না পেয়ে বললাম, পাত্র ভাল, তুমি সুখী হবে। কথাটা শুনে নিম্মি তার মুক্তোর মতো দাঁতগুলো বের করে হাসতে লাগল। কতদিন আমার বলতে ইচ্ছা হতো নিম্মি তোমার হাসিটা দেখলে বুঝা যায় আসলেই মানুষ হাসতে পারে; কিন্তু কোনদিন বলা হয়নি। আজ এ ইচ্ছাটা বড় বেশী করতে লাগল। কিন্তু আজও বলা হলো না। সব কথা কী বলা যায়।
তুমি আসবে। অবশ্যই - আমি তাড়াতাড়ি জবাব দিলাম যেন আমি না গেলে তার বিয়েই হবে না। আমাদের কত কিছুই বলার ছিল, কিছুই বলা হয়নি, না? নিম্মি এই যে কথাটা বলল, আমি এটার কোন অর্থ ধরতে পারলাম না। একটা কথা আমরা ছয় বছরেও বলতে পারলাম না, না? এ কথাটাও আমার বোঝার কথা; কিন্তু আমার মনে হতে থাকল নিম্মি ভুল বলছে। একবার তুমি আমাকে ছুঁয়েও দেখবে না? আমার খুব ইচ্ছে হলো নিম্মিকে একটু ছুঁয়ে দেই। আমি হাত ওঠানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু আবিস্কার করলাম কী যেন একটা অদৃশ্য জিনিস আমার হাতকে আটকে রেখেছে। আমার খুব বলতে ইচ্ছা হলো, নিম্মি তোমাকে ভালোবাসি।

নিম্মি ঘর থেকে ধীরপায়ে বেরিয়ে গিয়ে লাল টয়োটা করোলাটাতে উঠলো। আমি জানালা দিয়ে নিম্মির যাওয়া দেখতে লাগলাম। আমার হাতে সবুজ খাম। আমি খামটা খুলতে লাগলাম, অনুভব করলাম কেউ যেন আমার ভালোবাসাকে এই খামে আটকে ফেলেছে।

আমার আত্নহনন বিষয়ক জটিলতা

তৃতীয়বার আত্নহত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আমার হতাশা আরো প্রগাঢ় হওয়া শুরু করল।
আমেরিকা থেকে যখন দেশে ফিরে আসতে হল তখন আমি দেখলাম আমার চারপাশের সবকিছুই কেমন যেন পাল্টে গেছে। বন্ধুবান্ধব আগে যারা ছিল তাদের অনেকেই দেশের বাহিরে ,দেশে যারা আছে তারা বিয়েসাদি করে সন্তান-সন্ততি নিয়ে থিতু হয়েছে। প্রথমদিকে এরা অনেকেই আসত আমার সাথে দেখা করতে। সান্ত্বনা দিত,বলত দেখিস একসময় দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। অনেকেই এসে আমাকে দেখে বলার মত কোন ভাষা খুঁজে পেত না। এখন কেমন লাগছে,শরীরের কি অবস্থা এরকম দুচারটা কথা বলে চা-নাস্তা খেয়ে চলে যেত। শুধু বন্ধুবান্ধবই নয় নানান রকম লতায়-পাতায় আত্বীয়স্বজন,পাড়া-প্রতিবেশী যাদের সাথে গত দশ বছরেও কোন যোগাযোগ হয়নি তারাও আসত। বলত ভাগ্যকে কি আর কখনও খন্ডানো যায় দেখ দেশেই কিছু করা যায় কিনা,বসে থেকো না মনের উপর চাপ বাড়বে -এইসব কথাবার্তা আরকি। এইসব হল ভদ্রলোকের কথা। অভদ্রলোকের কথাও কিছু কিছু কানে আসত আমার। মোড়ের চায়ের দোকানদার সেদিন নাকি আমাদের বাসার কাজের ছেলেটাকে বলেছে “হইব না আম্রিকা নানান বেজাতের দ্যাশ,ঐহানে কার লগে কি করছে কে জানে,সব পাপের ফল,আল্লার বিচার”। হ্যাঁ,আল্লার বিচার নিয়েই আমি দেশে ফিরে এসেছিলাম।ধীরে ধীরে আমাকে দেখতে বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত লোকের আসা যাওয়া কমে যেতে শুরু করেছিল এবং এখন বলতে গেলে আর কেউই আসে না।

মিশিগানে থাকার সময়ও দেশে আমার বাসায় আমার জন্য আলাদা একটা ঘর ছিল। আমার সব ব্যবহৃত পুরানো কাপড়-চোপড়,বইপত্র,ক্রীড়া -সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় পাওয়া পুরস্কার ও সনদগুলো মা সাজিয়ে রাখতেন। মাঝে মাঝে আমাকে মনে পড়লে নাকি তিনি এগুলো পরিস্কার করতেন আর আমার স্মৃতি হাতড়াতেন।এবার দেশে আসার কিছুদিন পরই আমার স্মৃতিধন্য ঘরটি ছেড়ে দিতে হল,আশ্রয় নিতে হল ছাদের একটা চিলেকোঠার ঘরে। ছোটভাই নতুন বিয়ে করেছে ওর নাকি একটা বড় রুম দরকার। আমি আপত্তি করলাম না। আসলে বুঝতে পারছিলাম আমি ধীরে ধীরে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ছি। এরকমই হয়! ছাদের ঘরটিতে আমি আমার আলাদা জগত তৈরী করে নিয়েছি।তিনবেলা নিচ থেকে খবার আসে আর আমি চৈত্রের দুপুরে শহরের কাকদের সাথে আড্ডা দেই।সময় কাটে বড় বিষন্নতায়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা মনে পড়ে,মনে পড়ে বন্ধুদের কথা,স্মৃতি হাতড়াই ওদের সাথে তোলা ছবিগুলোতে,আমার জন্মদিনে ওদের দেয়া উপহারে। পনেরটার মত বিশেষ বই আছে আমার,বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার সময় চাপ কমানোর জন্য এগুলো আমি পড়তাম। এদেরকে আমি বলতাম চাপরোধীবিদ্যা।মাঝে মাঝে এই বইগুলোই বারবার পড়ি,চোখ ভিজে আসে আমার।

আমার পরিচিত পৃথিবী যে পাল্টে গেছে ,চেনা মানুষগুলো অচেনা ঠেকছে এর কারন একটাই-আমি আমেরিকাতে পড়তে গিয়ে দুইপা হারিয়ে ফিরে এসেছি।লং ড্রাইভে যাচ্ছিলাম আমি আর আমার এক বন্ধু।প্লেয়ারে চলছিল আমার পছন্দের গান জন ডেনভারের i am leaving on a jet plane dont know when i will back again……। আসলেই আমি জানতাম না এভাবে আমাকে ফিরে আসতে হবে।লরিটা নাকি বেশ বড়ই ছিল।অনেকে বলেছে বেচেঁ আছি এটাই নাকি ভাগ্য(!)। আমি আমার পাদুটো হারালাম সাথে আমার বন্ধুটিকেও।মাঝে মাঝে ভাবি ঐসময়ে বন্ধুটির চলে গেলেই ভাল হত,দেশে এসে ঝামেলা করতে হতনা। আমি আমার কাটা পাদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকি। চোঁখ চকচক করে ওঠে।
আগে রাস্তঘাটে পঙ্গু লোকজন দেখতাম। একজন ভিক্ষুককে পঙ্গু দেখলে আমার কোন অসুবিধা হত না কিন্তু মধ্যবিত্ত গোছের একজন শিক্ষিত যখন দেখতাম স্ক্র্যাচ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বা বেমানানভাবে বসে যাচ্ছে রিকসায় তখন আমার মনের মধ্যে একধরনের প্রশ্ন জাগত এই লোকটা বেঁচে আছে কেন?বেঁচে থেকে সে কি পাচ্ছে? দুনিয়ার হাজারো লোকের অস্বাভাবিক দৃষ্টি উপেক্ষা করে সে কিভাবে বেঁচে আছে তা কিছুতেই মাথায় ঢুকত না আমার,বিকলঙ্গতার চেয়ে আত্নহননই শ্রেয় মনে হত আমার।

হ্যাঁ,আত্নহত্যাই শ্রেয় এটা আরও বেশী করে মনে হল যখন আমি পাদুটো হারালাম। বিদেশে পড়তে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম ওগুলোর একটা গতি হওয়া দরকার,বাবা মাকে একবার অন্তত দেখে মরি এরকম সাত পাঁচ ভেবে আমি কায়েস হাসান যে কিনা যথার্থ মানুষ হওয়ার জন্য ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে বিদেশে পড়তে গিয়েছিলাম সেই আমি দেশে মৃত্যুর জন্য ডিসেম্বরের এক শীতের সকালে স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে ঢাকায় পৌছালাম।

প্রথমদিকে আমি ভেবেছিলাম আত্নঘাতি হওয়াটা এমন কঠিন কিছু হবে না,বিশেষত নাস্তিক ধরনের লোকের যখন পরকালের কোন চিন্তা নেই। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ব্যাপারটা যত সহজ হবে বলে চিন্তা করেছিলাম ততটা সহজ হচ্ছে না। আমি প্রথমে ফাঁস দিয়ে চেষ্টা করলাম।ছাদে কাপড় শুকাতে দেওয়ার রশি ফ্যানের সিলিংএ বাঁধলাম। কিন্তু আমার মনে হল সুইসাইড নোট বিষয়ক কিছু লেখা হয়নি,বাসার লোক ঝামেলায় পড়বে। খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়লাম।কেন জানি কিছুই লেখা হল না। ঝিম মেরে বসে থাকলাম কিছুক্ষন। মাথার ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। দ্বিতীয়বার আত্বহত্যার চেষ্টাটা খুবই হাস্যকর ছিল। শ্বাস বন্ধ করে ছিলাম একটানা অনেকক্ষন।চিন্তা করেছিলাম এভাবে নিঃশ্বাস বন্ধ করে মারা যাব। কিন্তু সবাই জানে এভাবে মরা যায়না।আমেরিকাতে আমি নানাভাবে মানুষের আত্নহত্যা দেখেছি। কেউ হাতের শিরা কেটে সব রক্ত বের করে মরেছে,কেউ গ্যাসের চুলার জ্বলন্ত শিখার নিচে মাথা দিয়ে মরেছে। দ্বিতীয়বার ব্যর্থ আত্বহনন প্রচেষ্টার পর আমি বুঝতে পারলাম এরকম কোনভাবেই আমার হবে না। তাই শেষবার আমি খুব কাপুরুষতার সাথে ঘুমের ট্যাবলেট দিয়ে আত্নহননের কথা ভাবলাম। পানিভর্তি একটা কাচের গ্লাসে গুনে গুনে পনেরটি ট্যাবলেট মিশিয়ে আমি বসে থাকি,আমার চিলেকোঠার ঘরের ঘড়িটিতে সময় গড়িয়ে যায়,রাস্তার মোড়ের কুকুরটি করুনসূরে ডাকতে থাকে আমার মরা হয় না।

পঙ্গু,অপাংক্তেয়,বিচ্ছিন্ন এই আমি একটি আত্নহত্যার স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকি।