মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই, ২০০৮

আমি বাংলাদেশ এখনও মরিনি - বেঁচে আছি

আমি বাংলাদেশ
আমাকে যারা তোমরা খুঁচিয়েছ,রক্তাক্ত করেছ
চোখ মেলে চেয়ে দেখ তারা আজ
এখনও আমি মরিনি
ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল অধিকার করে এখনো বেঁচে আছি
পলিসন্চন করে বাড়িয়ে তুলছি আমার অস্তিত্ব ।

আমার বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদীগুলো
একদা যাদের অস্তিস্তের সাথে মিশে থাকত নৌকা ও ইলিশ
এখন তাদের অধিকারে বিস্তীর্ণ বালুচর,কিম্ভুদরুপী বাঁধ
জেলেপাড়ার হারান মাঝি মাছ দেখেনা চোখে
বৃদ্ধ হারানের চোখে নদীগুলোর জন্য হাহাকার
মরে যাওয়া এসব প্রতিটি নদী
মৃত্যুর আগে বলে যাচ্ছে তোমরা হত্যাকারী
আমার নদীগুলোকে তোমরা হত্যা করছ
আমি বাংলাদেশ,আমাকে তোমরা হত্যা করছ।
মিলের গুদামে সারি সারি গাছের গুড়িগুলো
আসবাব ভেবে যাদের করেছ গুদামজাত
এদের বলতে দাও
এরা বলবে তোমরা হত্যাকারী
যুগ-যুগান্তরের আমার বৃক্ষেরা
আমার বুকে মাথা উচু করে দাড়ানো বৃক্ষেরা
এদেরকে তোমরা হত্যা করছ
আমি বাংলাদেশ,আমাকে তোমরা হত্যা করছ।
বায়ুতে আমার ভরছ বিষাক্ত সীসা
প্রবলভাবে শব্দাধিক্যর চর্চা করছ ডেসিবেলে
কর্ষিত জমির মধ্যে ভরে দিচ্ছ অ্যামোনিয়াম সালফেট
যেন ধমনীর মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছি পটাশিয়াম সায়ানেড
তবুও আমি বেচেঁ আছিএখনও না মরে বেচেঁ আছি।

আমি বাংলাদেশ বেঁচে থাকব
রক্তাক্ত,বিক্ষত আমি বেঁচে থাকব
আমার প্রতিটি শব্দ বেঁচে থাকবে যতদিন
আমার প্রতিটি বর্ণ বেঁচে থাকবে যতদিন
আটষট্টি হাজার সবুজ গ্রাম নিয়ে
মুখ থুবরে পড়ে থাকব ততদিন।

রবিবার, ২০ জুলাই, ২০০৮

যাপিতজীবন -০২ : : জমাট কলা কাহিনী

ছেলেবেলায় আমি কখনও জমাট কলা ( দুইটি কলা একসাথে থাকে ) খাই নি । আরও সহজভাবে বলতে গেলে জমাট কলা কখনও পাইনি যে খাব । আমাদের বাসায় আব্বা কখনও জমাট কলা আনতেন না । বাসায় সবাই জানত কোন পুরুষমানুষ জমাট কলা খেলে তার বৌ এর জমজ বাচ্চা হয় ! এক বাচ্চার দুনিয়ায় আসা আর তার বেড়ে ওঠা নিয়েই যত সমস্যা দুইটা বাচ্চার রিস্ক নেয় কোন বোকা ? তাই বাসায় পাওয়া এ শিক্ষাটা আমি অনেকদিন মেনে চলেছি । পরিচিত অনেক বন্ধু ও মানুষকেই পরবর্তিতে দেখেছি তারাও এ ঝুঁকি নিয়ে জমাট
কলা খান না । সুতরাং এই বিষয়টা নিয়ে কোথাও তেমন কোন বিড়ম্বনার মধ্যে আমাকে পড়তে হয়নি , মুখোমুখি হতে হয়নি বন্ধু-বান্ধবের টিটকারীরও ।

জমাট কলা না খেয়ে ,বৌয়ের ডাবল কাচ্চা-বাচ্চার ঝুঁকি এড়িয়ে দিন আমার ভালই যাচ্ছিল কিন্তু বিধাতার বুঝি আর সহ্য হল না । আঠারো বছর বয়সে যখন সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বান্ধবি( পড়ুন প্রেমিকা ) জোটানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ল তখন ঐ বয়সে আমার মধ্যে তীব্র বৈরাগ্যবোধ জন্ম নিল । এই অধমের মনে হল এই জীবন আর সংসার সব ঝুটা হ্যায় । কি লাভ এতে ? সিদ্ধান্ত নিলাম সারাটা জীবন অকৃতদারই থেকে যাব (এখন অবশ্য মাথা থেকে ভূতটা নামছে , মনে হচ্ছে বিয়াটা জরুরীই!)। বিয়েই যখন আর করছি না তাই বৌ বা কাচ্চা-বাচ্চা কিছুই আর হচ্ছে না । সুতরাং ডাবল বাচ্চার রিস্ক থাকা সত্ত্বেও জমাট কলা আমার জন্য হালাল হল । কিন্তু অন্য সকল ভাইরা যারা বিয়ে করেছিলেন বা বিয়ে করার মনস্ত করেছিলেন তাদের জন্য এই প্রজাতির কলা তখনও হারাম(!) ছিল । বলা বাহুল্য তার সুফল সেই সময় থেকে আমি পেতে শুরু করেছিলাম এবং এখনও পাচ্ছি । কিভাবে ? সেই হিসাবটাই আমি এখন বলব ।

একবার টার্ম ফাইনাল পরীক্ষার পর হলে খাবার-দাবারের প্রার্দুভাব দেখা দেয় । পর্যাপ্ত ছাত্র নাই এই হেতু প্রায় সব হলের (একটি বাদে ) ক্যান্টিন বন্ধ করে দেয়া হয় । আহার গ্রহনের নিমিত্তে জৈষ্ঠ মাসের তালপাকা দুপুরে দূরবর্তী হলের ক্যান্টিনে নির্দিষ্ট সময়ে যেতে হয় । সময়ের একটু এদিক ওদিক হলেই সারা ! গিয়ে কতগুলো টেবিলে ছাত্রদের চাবানো মুরগীর হাড় ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না । সুতরাং সময় নিয়ে সবসময় তৎপর থাকি । কিন্তু বন্ধের মাসে কতই বা আর ঘড়ি ধরে চলা যায় ? দুপুরের প্রবল ঘুমের তোড়ে একবার ক্যান্টিনের টাইম মিস হয়ে যায় । অগত্যা ক্ষুধায় কাতর আমি যাই পলাশী বাজারে রুটি আর কলা কিনতে । তখন দ্রব্যমূল্যর উদ্ধগতিতে প্রতি পিস কলার দাম সবে দুই টাকা থেকে তিন টাকা হয়েছে । এমনিতেই সারা মাস বাহিরে বাহিরে খেয়ে পকেটের অবস্থা টাইট তারপরে দোকানীও দেখি বা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির সমান কলা তিন টাকা করে চায় প্রতিটা । মেজাজ অত্যধিক খারাপ । জমাট দুইটা কলা দেখিয়ে দোকানীকে বলি আলাদা দুইটার ঝামেলা না করে ঐ দুইটাই দিন । দোকানীকে দশ টাকার একটা নোট দেই। দোকানী আমাকে সাত টাকা ফেরত দেয় । আমি লোকটার কান্ডজ্ঞান দেখে অবাক হই । এরে দিয়ে ব্যবসা হচ্ছে কিভাবে ? দোকানীকে বলি আমি তো দুইটা নিছি আপনি একটার দাম রাখছেন । দোকানীও মনে হয় আমার কান্ডজ্ঞান দেখে অবাক হয় । বলে জমজ কলার দাম একটার দামের সমান । দোকানীর ভাবটা এমন এই সাধারণ জিনিসটা আমি এতদিন জানতাম না ! আমি যুগপৎ অবাক আর আনন্দিত হই । এই চরম দুর্দিনে একটার দামে দুইটা কলা ( হোকনা জমজ) পাওয়া যাচ্ছে এটা কি কম আনন্দের ! আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ঐ দোকানেই শুধু মনে হয় এই হিসাব কিন্তু পরে অন্য দোকানেও দেখেছি একই অবস্থা । আমি সেই থেকে কলার দোকানে গেলে জমাট কলা খুঁজি । একটা কলার দামে যখন দুটি পাওয়া যাচ্ছে সেখানে আলাদা করে দুটি কিনে দোকানীকে বেশী টাকা দিয়ে কি লাভ !

সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০০৮

যাপিতজীবন -০১ : : পরিচয় সংকট

লোকগুলোর সাথে আমাদের দেখা হয় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার সূরা মসজিদে । তিনজন লোক , সবাই মধ্যবয়স্ক । মসজিদের সামনের বিশাল তেঁতুল গাছের নিচে বসে হয়ত বাতাস খাচ্ছিলেন তারা ।

আমরা গিয়েছি মসজিদটা দেখতে । অনেক পুরানো ঐতিহাসিক মসজিদ যেটা ঠিক কখন তৈরী হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না । স্থানীয়দের সাথে এ মসজিদটা নিয়ে একটু কথা বলতে ইচ্ছে হল আমাদের । লোকগুলোকে দেখে আমাদের ভালই লাগল যাক বেশ হল আমারাও ওনাদের সাথে তেঁতুল গাছের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নেই আর গল্প করি । আমিই প্রথম কথা বলতে শুরু করি তাদের সাথে-আপনারা কি এই গ্রামেরই ।
-হ্যাঁ , এখানকারই ।
ঐ পাশে বাড়ী ।একটা লোক ইশারা করে সবুজ ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ওনাদের বাড়ি দেখিয়ে দেয় আমাদের । আমি একজনের হাতে একটা নাইলনের ব্যাগ দেখি ভিতরের কি জানি কুঁ-কুঁ আওয়াজ করছে । কৌতুহল হয় ভিতরে কি আছে জানার । আমি আবার জিজ্ঞাসা করি
-ব্যাগের ভিতরে কি ?
লোকগুলোর মধ্যে একটা কেমন যেন অস্বস্থিভাব দেখতে পাই । একজন মৃদুকন্ঠে জবাব দেয়-ইঁদুর
বুঝতে বাকি থাকে না লোকগুলো সাঁওতাল আর এরা এগুলো খাওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে । তারপরও জিজ্ঞাসা করি
-এগুলো তো খাবেন তাই না ?
লোকগুলোর মধ্য অস্বস্থিভাবটা আরো প্রকট হয়ে ওঠে যদিও আমার জিজ্ঞাসা করার মধ্যে কোন অস্বাভাবিকতা ছিল না ।
-হ্যাঁ , খাব । আমরা আদিবাসি ।
মুখ শুকনো করে বলে একজন । তাদের মুখ থেকে আমরা তাদের আসল পরিচয়টা পাই কিন্তু পুরোটা পাইনা । তারা হয়ত এটা বুঝতে শিখেছে সাঁওতাল বলার চেয়ে আদিবাসী বলাটা আমাদের মত ভদ্র পোশাক-আশাক পরা লোকের কাছে অনেকটা শোভন । আমি জিনিসটা আরেকটু নাড়াতে চাই
- সাঁওতাল তাই না ?
-হ্যাঁ ।
লোকগুলোর মুখ আরো শুকনো হয়ে ওঠে । একজন আবার বলে এখন সাঁওতাল আর অন্য সমাজের (পড়ুন হিন্দু বা মুসলমান সমাজ) মানুষের মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই , সবাই ক্ষেত-খামারের কাজ করছে একসাথে , আগের মত বন-জঙ্গলও নেই শিকার-টিকারও নেই । আমাদের মত ভদ্রস্থ শার্ট-প্যান্ট পড়ে আসলে নাকি আমরা তাদের চিনতেই পারব না তারা সাঁওতাল আরেকজন বলে ।

লোকগুলো তাদের গা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাঁওতাল গন্ধ মুছে ফেলতে চায় , যত তাড়াতাড়ি পারে মিশে যেতে চায় সাধারণের মাঝে যাতে তাদের হঠাৎ করে সাঁওতাল বলে তাদের আলাদা করা না যায় । সাঁওতালদের একটা নিজস্ব কৃষ্টি আছে , কালচার আছে । কি এমন কারন যার জন্য একটি সম্প্রদায়কে তাদের পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করতে হয় , প্রজন্মকে ভুগতে হয় আত্বপরিচয় বিষয়ক সংকটে ? আমরাও কি এর বাহিরে আছি ?