শনিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০০৮

আগুন্তকে আপত্তি

রাতুলের বাবার কথা:
রাতুল অর্ন্তমুখী স্বভাবের ছেলে এটা আমরা জানি । ও একা একা থাকতে চায় , আমরা বেশী কথাবার্তা বলতে চাইলে বিরক্তবোধ করে । এজন্য আমরা ওকে কম ঘাটাই । কিন্তু এবার ঢাকা থেকে গরমের ছুটিতে বাসায় আসলে ওকে কেমন যেন অন্যরকম লাগে , আমাদের সাথে কথা বলা আরও কমিয়ে দেয় । আগে বাসায় এসেই নিয়মমাফিক পড়াশুনা চালু রাখত । ওর আম্মা বলত ঢাকায় তো মেসে পড়াশুনা করই , এখন বাসায় আসছ একটু রিলাক্স কর , বাহিরে বেড়াও,বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা কর । কিন্তু ও যেত না । এবারের ব্যাপারটা কেমন জানি অন্যরকম । পড়াশুনা করে না , টিভিও দেখেনা , সারাদিন রিডার্স ডাইজেস্টের কতগুলো পুরানো সংখ্যা নিয়ে পড়ে থাকে । ওকে দেখলেই মনে হয় ভিতরে ভিতরে বেশ অস্থির একটা ভাব ,অসংলগ্ন কথাবার্তাও বলে মাঝে মাঝে । শুনলাম ওর মার সাথেও নাকি খারাপ ব্যবহার করেছে সেদিন । আমি একটু আশ্চর্য হই । ও বরাবরই ভদ্রগোছের একটা ছেলে । আমাদের সাথে শেষ কবে গলা উচু করে কথা বলেছে তা আমার মনে পড়ে না । আমি রাতুলের হঠাৎকরে এরকম পাল্টে যাওয়াতে আশ্চর্য হই , দুঃচিন্তাও হয় বেশ । সামনে এইচ,এস,সি পরীক্ষা ,রেজাল্টটা খারাপ হয়ে গেলে তো মেডিকেলে ভর্ত্তি হতে সমস্যা হবে। ওর মাকে আমি জিজ্ঞাসা করি কি ব্যাপার কোন সমস্যা হয়েছে নাকি । উঠতি বয়সের ছেলেদের প্রেম বা মেয়ে বিষয়ক সমস্যা থাকে সেরকম কোন সমস্যা হল কিনা , ঢাকায় মেসে নানান ধরনের ছেলেদের সাথে থাকে ওখানেও সমস্যা হতে পারে এগুলোই বলি ওর মাকে । ওর মা বলে না তেমন কোন সমস্যা মনে হয় নেই ,সব ঠিক হয়ে যাবে । আমার কেমন জানি মনে হয় ওর মা কিছু একটা এড়িয়ে যাচ্ছে । আমি ঢাকায় রাতুলদের মেসে ফোন করি , কথা বলি ওর রুমমেটের সাথে । ছেলেটা বলে না আংকেল এখানে কোন সমস্যা হয় নি । পাশের বাসার বদরুল ছেলেটা বয়সে ওর থেকে কয়েক বছর বড় হলেও দেখি রাতুলের সাথে ওর বেশ মিল । আমি বদরুলকেও জিজ্ঞাসা করি কি রাতুল কিছু বলেছে কিনা । এ ছেলেটার কাছেও তেমন কোন সদুত্তর পাই না । আমি এবার আসলেই দুঃচিন্তায় পড়ে যাই , সমস্যার কারন খুঁজে না পেলে সমাধান করি কিভাবে । তাছাড়া আমার সাথে ওর আলাদা একটা দূরত্ব আছে হুট করে জিজ্ঞাসাও করতে পারিনা মেয়েঘটিত কোন সমস্যা কি না ।

রাতুলের মায়ের কথা :
রাতুল এবার ঢাকা থেকে আসার পর ওকে কেমন জানি অন্যমনস্ক লাগে । খেতে ডাকলে ঠিকমত আসে না , বলে টেবিলে সাজিয়ে রাখেন পরে খেয়ে নেব । কথাবার্তা কিছু জানতে চাইলে আগে তবু হা -না করে উত্তর চালিয়ে দিত কিন্তু এখন দেখি প্রশ্নটাও অগ্রাহ্য করে , দু-তিনবার জিজ্ঞাসা করলে তবে উত্তর দেয় । আমি বুঝতে পারি ওর কোন একটা সমস্যা হয়েছে , হঠাৎকরে ওর এরকম পাল্টে যাবার কথা নয় । ওর বাবাও বিষয়টা বুঝতে পারে আমার কাছে জানতে চায় । আমি রাতুলকে বারবার জিজ্ঞাসা করি কোন সমস্যা হয়েছে কিনা । ও বলে না কিছু হয়নি । আমি পিছু ছাড়ি না । কয়েকদিন অনবরত জিজ্ঞাসা করার পর ও সমস্যাটা আমাকে বলে । কথাটা বলতে ও একটু ইতস্তত করছিল । আমি ওকে বলি ও যেকোন কথা নির্ভয়ে বলতে পারে। এরপর রাতুল যে কথাটা বলে তাতে আমি খানিকটা বিস্মিত এবং খানিকটা লজ্জিতও হই । ও বলে "আপনারা যে নতুন বাচ্চা নিচ্ছেন এটা আমার পছন্দ না " । আমি লজ্জিত হয়ে পড়ি , কি বলব বুঝতে পারিনা । আমি বলি ছি বাবা-মার মধ্যে সন্তানদের এসকল বিষয়ে আসা ঠিক না।

একটা মেয়ে সন্তানের স্বপ্ন আমার বহু দিনের । রাতুল হওয়ার পর থেকেই আমি স্বপ্নটা দেখতে শুরু করি । সন্তানও নিয়েছিলাম একটা আমরা এর কয়েক বছর পর । একটা ছেলে হয়েছিল আবার । কিন্তু ছেলেটা মাসদুয়েকের বেশী বাঁচে নি । এরপর চাকুরী , রাতুলকে বড় করতে করতে সময় কেটে যেতে থাকে । আমার আর রাতুলের বাবার বিয়ে হয়েছিল খুব অল্প বয়সে তখন আমরা সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি । আমি তৃতীয় বর্ষে পড়তেই রাতুল জন্মগ্রহন করে , আমি তখন বাবারও বাড়ীতেই থাকি । তাই সবসময়ই আমি ভাবতাম নতুন একটা সন্তান নেবার সময় এখনও আছে। এখন যখন আমরা আরেকটা বাচ্চা নেবার কথা ভাবছিলাম তখন হয়ত আমাদের মনে রাখা উচিত ছিল রাতুল অনেক বড় হয়ে গিয়েছে , ওর কথা একবার ভাবা দরকার । আমাদের একটা ভুল হয়ে গেছে , মস্ত ভুল হয়ে গেছে । ওর বাবাকে আমি কথাটা বলতে পারিনি, এড়িয়ে গেছি।রাতুলের সামনে যেতে এখন আমার কেমন জানি একটা লজ্জা লাগে ।

রাতুলের কথা :
ঘটনাটা আমি প্রথম শুনি ঢাকা থেকে গরমের ছুটিতে বাসায় ফিরে । ইন্টারমেডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে কলেজে পড়াশুনার খুব চাপ বাসায় বলতে গেলে চার মাসে একবার আসা হয়। সামনে এইচ ,এস ,সির বাছাই পরীক্ষা , পড়াশুনা আরেকটু ভালোভাবে করার জন্যই হয়তোবা গরমের ছুটিটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিল । আমিও ভাবলাম ভালই হয়েছে ,এবার বাসায় গিয়ে চরমভাবে পড়াশুনা করতে হবে । বাসায় এসে ঘটনাটা আমি প্রথম শুনি বাসার কাজের মেয়ের কাছে । আম্মা- আব্বা অফিসে ,আমি বাসায় এসে সবে ফ্যানটা ছেড়ে ব্যাগটা খুলছি এমন সময় কাজের মেয়েটা বলে ভাইজান খবর শুনছেন , আফনার তো বইন হইব । আমি ভালই আশ্চর্য হই । আম্মা বাসায় ফিরলে দেখি ঘটনা সত্যই, আম্মার পেটটা বেশ ফোলা । আমার কেন জানি কান্না আসতে চায় , লজ্জায় আমি মিশে যেতে থাকি মাটিতে। আমি পড়াশুনা করতে চাই , মনোযোগ বসে না । নানান ধরনের অদ্ভুদ বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকি আমি । এতদিন কারো সাথে প্রথম পরিচয়ে সে জানতে চাইত আমরা কয় ভাইবোন । আমি সবসময় বলতাম আমি একাই । এখন এরকম কাউকে বলতে হবে আমরা দুইজন , আরেকজন আছে সে ছোট , এখনও স্কুলে যায়না । বিষয়গুলো ভাবতে আমার মাথাটা কেমন জানি গুলিয়ে ওঠে , বাসার পরিচিত পরিবেশ অচেনা হয়ে ওঠে , খারাপ ব্যবহারও করি দু-একদিন আম্মার সাথে । আমার চোখে একটা ঘটনা ভেসে ওঠে । স্কুলে থাকতে আমার ফাজিল চাচাতো ভাই সাবেরএকদিন একজনকে জিজ্ঞাসা করেছিল ওরা কয় ভাইবোন । ছেলেটা উত্তর দেয়ার পর সাবের বলেছিল আর কি দুই একজন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমি সাবেরের সাথে ছিলাম , ঘটনাটা দেখে আমি মুচকি হেসেছিলাম । সাবের বেশীদিন বাঁচে নি । এস,এস,সি পরীক্ষা দেওয়ার পর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল । কয়েকদিন হল আমার মনে হচ্ছে সাবের যেন আমার কাছে পিছে আছে । আমাকে সুযোগ পেলেই জিজ্ঞাসা করছে কি আর দুই একজন কি হওয়ার সম্ভাবনা আছে ।

আমার মনে হচ্ছে আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছি ।