শুক্রবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০০৯

একটি উত্থান-পতনের গল্প

অনেকদিন পর শহীদ কাদরীর "একটি উত্থান-পতনের গল্প " কবিতাটা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে । আমি বুঝতে পারি আমার সময় এসেছে , একটি আত্নজীবনীমূলক ব্লগে লেখার সময় এসে পড়েছে । আগে কাদরীর কবিতাটিতে একটু চোখ বুলিয়ে নিন

একটি উত্থান-পতনের গল্প
শহীদ কাদরী
আমার বাবা প্রথমে ছিলেন একজন
শিক্ষিত সংস্কৃতিবান সম্পাদক
তারপর হলেন এক
জাঁদরেল অফিসার ;
তিনি স্বপ্নের ভেতর
টাকা নিয়ে লোফালুফি খেলতেন
টাকা নিয়ে ,
আমি তাঁর ছেলে প্রথমে হলাম বেকার ,
তারপর বেল্লিক
তারপরো বেকুব
এখন লিখি কবিতা
আমি স্বপ্নের ভেতর
নক্ষত্র নিয়ে লোফালুফি করি
নক্ষত্র নিয়ে ;
--------
-------
বাবা যখন-তখন যাকে-তাকে চপেটাঘাত করতে পারতেন ।
আমি কেবল মাঝে-মধ্যে একে-ওকে চুম্বন ছুঁড়ে মারতে পারি ,ব্যাস !
প্রবল বর্ষার দিনে বাবা
রাস্তায় জলোচ্ছ্বাস তুলে স্টুডিবেকারে ঘরে ফিরতেন,
আমি পাতলুন গুটিয়ে স্যান্ডেল হাতে
অনেক খানাখন্দে পা রেখে এভিনিউ পার হ'তে চেষ্টা করি
বাবার নাম খালেদ-ইবনে-আহমাদ কাদরী
যেন দামেস্কে তৈরী কারুকাজ-করা একটি বিশাল ভারী তরবারী,
যেন বৃটিশ আমলের এখনও-নির্ভরযোগ্য কোনো
ঝনঝন ক'রে-ওঠা ওভারব্রীজ ,
আমার নাম খুব হ্রস্ব
আমার নাম শহীদ কাদরী
ছোটো,বেঁটে - ঝোড়ো নদীতে
কাগজের নৌকার মতই পলকা
কাগজের নৌকার মতই পলকা ।

শহীদ কাদরীর এই কবিতাটা মনে হলে আমারও বাবার কথা মনে হয়। আমার বাবা মফস্বল কলেজের শিক্ষক , সাবদার রহমান সরকার । সকালে ঘুম থেকে উঠে চা খেতে বের হন ,মোড়ের চায়ের দোকানে আড্ডা বসান বন্ধুবান্ধবদের সাথে । পুরোদস্তুর ফিটফাট হয়ে মোটরবাইকে রাস্তার ধূলা উড়িয়ে কলেজে যান। ধূলারা যেন তার শত্রু ,উড়ে যাতে চায় চারপাশে । আমি তার ছেলে ইমরুল কায়েস , এখন পর্যন্ত শেখা হয় নি সাইকেলে চড়া , সাঁতারও জানি না। আমার বাবা কলেজ থেকে ফিরে বাইকে করে গ্রামে যান , নিঁখুত চাষার মত আবাদ করেন শষ্যক্ষেত্র , মাছের চাষ করেন পুকুরে , শ্যালো মেশিনের পাহারাদারকে শাসান , ক্ষেতের কৃষকরা অনিয়ম করলে কেঁপে ওঠে । অদ্ভুদ প্রাণশক্তিতে পরিপূ্র্ণ একজন মানুষ তিনি । আমি তার ছেলে , আপাদমস্তক অলস , হতাশ আর বিভ্রান্ত এক যুবক । ঘুমাই সারাদিন , বাইরে বেড়োই কম , হাঁটি আরো কম ,পা ব্যথা করে ,ঘরের এক কোণে বসে পড়া মুখস্ত করি আর ভার্চুয়াল জগতে রাজা উজীর মারি ।

বাবা অল্পবয়সে নৌবাহিনীতে ঢোকেন , পালিয়েও আসেন একসময় । পালিয়ে এসে কলেজ ঢোকেন , বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন । চ্যালেন্জ নিতে উনি ভালবাসেন। আমি তার ছেলে , আমিও পালাই । কলেজে পালাই , বিশ্ববিদ্যালয়ে পালাই ,পড়াশুনা আমার ভাল লাগে না । পালিয়ে গিয়ে কোথাও মাসখানেক থাকব এমনটা আর হয় না , পালিয়ে আবার বাড়িতেই যাই । সুবোধ ছেলের মত দুই দিন পর বাড়ি থেকে ফিরে আসি , আবার পড়া মুখস্ত করতে বসি । চ্যালেন্জ মোকাবেলায় আমার বড় ভয় । চ্যালেন্জরা যেন একেকটা বিরাটাকার বিড়াল , আমি তাদের কাছে ইঁদুরদের মত মুষড়ে পড়ি ।

আমার বাবা রাজনীতি করেন , প্রতিরাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে এগারো-বারোটায় ফেরেন । রাজনীতির মাঠে তার প্রতিপক্ষ আছে , দাঙ্গা-হাঙ্গামার ভয় আছে । আমি তার ছেলে নিতান্ত সাধারণ , দেশ-দশের নেতৃত্ব তাকে দিয়ে হবে না । আমার কোন প্রতিপক্ষ নেই । প্রতিপক্ষকে আমি ভয় পাই , কেউ পতিপক্ষ হতে চাইলে আমি বাঁধা দেই , আমার দাঙ্গা-হাঙ্গামার বড় ভয় । হলের গেটে কেউ মার খেলে আমি চারতলা থেকে লাইট বন্ধ করে দেখি , নিচ থেকে আসা লাঠির শব্দে আমার আমার অন্তরাত্না কেঁপে ওঠে । মারা শেষ হয়ে গেলে তারা যখন উপরে একটা মাথা দেখে আর অন্ধকারকে উদ্দেশ্য করে বলে 'এই উপরে কে দেখে ?' , আমি তখন সরে যাই , আমার মনে হয় এখনই না সরলে কেউ একজন এসে মারতে শুরু করবে আমাকে । আমি মারামারি আর হট্রগোল বড় পাই । এই আমি তেইশ বছরের যুবক ইমরুল কায়েস আপাদমস্তক ভীতু , আজন্ম কাপুরুষ ।

আমার বাবার নিয়ন্ত্রন যোগ্য মানুষের কখনও অভাব হয় না । তিনি যখন কাউকে বলেন 'যাও অমুকটা করে আস' , তখন তারা প্রবলভাবে দৌড়ায় , তাদের দৌড় দেখলে মনে হয় তারা যেন শয্যাগত প্রায় মৃত আত্নীয়ের জন্য 'ও নেগেটিভ' রক্তের খোঁজে দৌড়াচ্ছে ব্লাড ব্যাংকে । আমার এরকম নিয়ন্ত্রনযোগ্য মানুষ কখনও হয় না । আমিও যদি বলি 'যাও অমুকটা করে আস' তখন যাকে বলি সে হয় শুনতে পায় না অথবা অনেক পড়ে বলে 'কি বলেছিলে ভুলে গেছি'। আমি তাদের এরকম ভুলে যাওয়া মেনে নেই , মানুষই তো ভুলে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ! আমার বাবার কন্ঠে যেন ইস্রাফিলের শিংগার মত আওয়াজ । একবার যখন তিনি বলেন 'না' তখন চারপাশ যেন গমগম করে উঠতে থাকে , তারাও বলতে থাকে 'না,না, কিছুতেই না ' । আমি সচরাচর না বলি না । না বলতে আমার ভয় হয় । যদি পারতপক্ষে কখনও 'না' বলি , আমার বছরময় সর্দিভেজা গলা বেয়ে উঠতে তার প্রাবল্য কমে আসে , 'হা' এর মত শোনায় খানিকটা । যারা শোনে তারা বলে "হ্যাঁ ঠিকই বলছ ,এই বিষয়টা না হওয়ার কোন কারন নেই'।

আমার বাবা রোমান্টিসিজমে বিশ্বাস করেন । যুবক বয়সে তিনি মন দেয়া নেয়া করেন যার সাথে পরিনত বয়সে তাকেই বিয়ে করেন । রোমান্টসিজমের আতিশয্যে তিনি লেখেন ডায়েরি '"শেফালী নামের মেয়েটি " । সে ডায়েরী পড়লে যে কেউ তাকে রোমান্টিক একটা উপন্যাস বলে চালিয়ে দিতে পারে । আমি তার ছেলে , পুরোটাই যান্ত্রিক ,তেইশ বছর নারীসঙ্গবিহীন , তেইশ বছর নারীস্পর্শবিহীন ,ঘড়ির কাঁটাকে সব বুঝিয়ে দেয়া যুবক। তাদের দেখলে আমার রুক্ষ কন্ঠ আরো রুক্ষ হয়ে ওঠে , হাত পা কেঁপে ওঠে ভয়ে । তাদের কেউ একজন কোন এ সময় বলে ওঠে 'ইওর ভয়েস ইজ ভেরী হার্শ' । আমার রোমান্টিসিজমে আক্রান্ত হতে বড় ভয় হয় ।

আমার বাবাকে আমার একটি প্রাচীন বটগাছ বলে মনে হয় , অনেকেই তার ছায়ায় থাকে , অনেকেই তার ছায়ায় থেকে খুশি হয় । আমার নিজস্ব কোন ছায়া নেই ,আমি কাউকে ছায়া দিতে পারি না । অন্যের ছায়ায় থাকতেই আমি অভ্যস্ত, ছায়া সরে আমি বিপদাক্রান্ত হই । পরগাছা হয়ে আমি বটগাছকে জড়িয়ে ধরতে ভালবাসি । আমার বাবা উত্তর বাংলার এক সময়কার সাহসী যুবক , বর্তমান সময়ের এক কর্মঠ আর প্রানবন্ত মানুষ । আর আমি তার ছেলে জন্ম-জন্মান্তর থেকে নুয়ে আসা মানুষ, উত্তর বাংলার এক আহত যুবক । শহীদ কাদরীর মত আমারও বলতে ইচ্ছে "আমি"-

ছোটো,বেঁটে - ঝোড়ো নদীতে
কাগজের নৌকার মতই পলকা
কাগজের নৌকার মতই পলকা ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন